রোহিঙ্গাদের তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নেয়ার বাংলাদেশি প্রস্তাব নাকচ মিয়ানমারের
সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসকারী আরাকানের মুসলিম নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নেয়ার বাংলাদেশি প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে মিয়ানমার। বার্তা সংস্থা ডিপিএ’র খবরে এ তথ্য জানা গেছে। এর আগে গত রোববার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব অনুযায়ী খুব তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না করলেও দু’দেশের মধ্যে গত আগস্টে অনুষ্ঠিত ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)’ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবরকম কাজ স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এগিয়ে চলছে।
গতকাল মিয়ানমারের রাজধানী থেকে পরিবেশিত বার্তা সংস্থা ডিপিএ এক সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ই টুট তার ফেসবুক পাতার কমেন্টে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বলেছেন, আমাদের নাগরিকত্বের চার নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত মিয়ানমার। নাগরিকত্ব প্রমাণের চার নিয়মের মধ্যে পিতা-মাতার দু’জনই মিয়ানমারের নাগরিক এ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত আছে।
ই টুট তার বক্তব্যে আরো বলেন যে, তিনি (থেইন সেইন) বলেছেন যে খুব তাড়াতাড়ি তাদের ফিরিয়ে আনাটা সম্ভব নয়।
গত রোববার বেইজিংয়ের ফাং হুয়া হলে অ্যাপেক সিইও শীর্ষ সম্মেলনের এক পর্যায়ে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বলেন, আরাকান (রাখাইন) প্রদেশে থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ এদেশে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দ্রুত প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেন।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনানুযায়ী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্মগত সূত্রে নাগরিকত্ব স্বীকার করা হয়নি। মিয়ানমার সরকার ও আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের বেশিরভাগ নাগরিক যারা বৌদ্ধ জাতিগত সম্প্রদায়ের নাগরিক তারা মুসলমানদের নাগরিকত্বের দাবি স্বীকার করে না। উল্টো তাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আসুদ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা ফেরত বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। চলতি মাসের ১৩ তারিখ ওয়ার্কিং গ্রুপ বৈঠক করবে। এফওসি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের সবরকম কাজ স্বাভাবিক পদ্বতিতে এগিয়ে চলছে।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সচিব পর্যায়ের ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)’ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে প্রাথমিকভাবে দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এরা সকলেই মিয়ানমারের নাগরিক বলে ওই বৈঠকে উভয় দেশের প্রতিনিধিরা একমত পোষণ করেন। ওই বৈঠকে মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন সে দেশের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান চ। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেন। সেসময় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানান, দুই দেশের কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় কাজ করবে।
ডিপিএ প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে আসুদ আহমেদ বলেন, সংবাদটি দেখে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে।
কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ৩২ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে তার একটি জরিপ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই জরিপ সম্পর্কে গত আগস্টে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’ বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক সাদিয়া মুনা তাসনিম সাংবাদিকদের জানান, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত করা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলেই বাকিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।