আমেরিকায় ৩০ বছর
খলকু কামাল
সেই আড়াই যুগ আগের কথা। ১৯৮৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রিয় জন্মভূমি সিলেট মহানগরীর শেখঘাট ছেড়ে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় ব্রিটিশ এয়ারযোগে লন্ডন হয়ে প্রথমবারের মতো ভিনদেশে পাড়ি জমাই। বসবাস শুরু করি সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে নিউ ইয়র্কের মতো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম নগরীতে।
লন্ডনে তিন সপ্তাহ থাকার পর ৪ঠা অক্টোবর নিউ ইয়র্কে এসে ম্যানহাটন ডাউনটাউনে বড় বোনের বাসায় উঠি। আড়াই যুগ বসবাস করার পরও বাংলাদেশকে, প্রিয় জন্মভূমি সিলেট শহরকে, শেখঘাটকে এতটুকু ভুলতে পারিনি। মনে পড়ে সিলেটের মানুষের কথা, স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠে প্রিয় সিলেট শহরের কথা। মায়ের পেট থেকে জন্ম নিয়ে যে শহরের আলো-বাতাসে বড় হয়েছি। বাবা-মা, ভাই- বোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে বিশাল অট্টালিকা শহর নিউ ইয়র্কে বাস করার পরও মনটা কাঁদে আমার প্রাণপ্রিয় তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র বাংলাদেশের জন্য। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের কথা অহরহ মনে পড়ে।
প্রিয় পাঠক, আমি আপনাদেরকে প্রথমে নিয়ে যাচ্ছি ৮৪-৮৫ সালে। তখনকার সময় পুরো নিউ ইয়র্কে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশী ছিলেন। এ তথ্য পাই তৎকালীন সময়ে বগুড়ার সাংবাদিক আশরাফুল ইসলামের পরিচালনায় ‘পদ্মার ঢেউ’ নামক রেডিওর মাধ্যমে। আমরা দেশের সর্বশেষ খবরাখবর পেতাম এর মাধ্যমে। এরই মধ্যে ’৮২-৮৩ সালে জার্মানি থেকে শ’ শ’ বাংলাদেশী বাহামা দ্বীপ হয়ে নিউ ইয়র্কে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। সে সময় পুরো নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশী পরিচালনায় একটি মাত্র মদিনা মসজিদ ছিল। তার সভাপতি ছিলেন ইব্রাহিম চৌধুরী নামে একজন ধার্মিক ও উচ্চ শিক্ষিত ভদ্রলোক। তার বাড়ি বৃহত্তর সিলেটে। তিনি এ দেশে আসেন ১৯২৬ সালে। ’৮৫ সালের শেষের দিকে জ্যামাইকা ও ব্রুকলিন চার্চ ম্যাকডোনাল্ড এভিনিউতে ২টি মসজিদ স্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়। সে সময় সাবওয়ে ভাড়া ছিল ৯০ সেন্ট, চাকরির বেতন ছিল ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ৩.৩৫ সেন্ট। ঘর ভাড়া ১ বেড রুমের তিনশ’ ডলার, ২ বেড রুম ৫শ’ ডলার আর তখন নিউ ইয়র্ক-ঢাকা রিটার্ন টিকিটের ভাড়া ছিল ৬ শত ৫০ থেকে ৭ শ’ ডলার। ৩০ বছর পর ২০১৪ সালে সাবওয়ে ভাড়া ২.৫০ সেন্ট, কাজের ন্যূনতম বেতন ৮ ডলার, ঘর ভাড়া ১ বেড রুম ১ হাজার থেকে ১৫ শত ডলার পর্যন্ত। ২ বেড রুম ১৩ শ’ থেকে ২ হাজার ডলার পর্যন্ত। নিউ ইয়র্ক-ঢাকা রিটার্ন টিকিট শীতকালীন সময়ে ১ হাজার থেকে ১২শ’ ডলার। আবার সামার সিজনে দেড় হাজার ডলার থেকে ২ হাজার ডলার পর্যন্ত। আবার কেউ যদি সস্তায় বাড়ি ভাড়া চান তাহলে আপনাকে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে লুজিয়ানা, মিশিগান অথবা বাফেলোতে। সেখানে এই মুহূর্তে বাসা রয়েছে ১ বেড রুম তিনশ’ ডলার, ২ বেড রুম ৪ থেকে ৫শ’ ডলার। আবার অন্যান্য যে কোন জিনিসপত্রের দাম নিউ ইয়র্কের তুলনায় অনেক অনেক গুণ সস্তা।
বর্তমান বিশ্বে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, জুরিখ ও টোকিওতে বাসা ভাড়া মারাত্মক। ’৮৬ সালে নোয়াখালীর সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ নিউ ইয়র্কে প্রথমবারের মতো সাপ্তাহিক প্রবাসী নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকা বের করতেন। অনেক দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করে বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের খবর সংগ্রহ করে নিজে বাংলা টাইপ করে বিভিন্ন দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ অনেকের মধ্যে পত্রিকাটি বিলি করতেন। সে সময় টেলিযোগাযোগ সিস্টেম উন্নত ছিল না। ’৮৪ থেকে ’৯১ পর্যন্ত দেশ থেকে কয়েকশ’ স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় আগমন করেন। আবার ’৯১ এর পর থেকে আমেরিকা সরকার নতুন আইন তৈরি করে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লটারির মাধ্যমে ওপি ওয়ান ও ডিভি ভিসায় লোকজনকে আনা শুরু করে দেয়। এভাবে ধাপে ধাপে বাংলাদেশীদের আগমন শুরু হয়। ২০১৪ সালের সর্ব শেষ হিসাব মতে, পুরো মার্কিন মুল্লুকে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশী রয়েছেন। এর মধ্যে নিউ ইয়র্কে বাস করেন প্রায় ২ লাখ। এর পরের স্থানে রয়েছে মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউজার্সি, বাফেলো, ভার্জিনিয়া, ওয়াশিংটন, জর্জিয়া, আটলান্টা, টেকসাস ও ফ্লোরিডাসহ অন্যান্য সিটিতে। তবে নিউ ইয়র্কের আনাচে-কানাচে বাংলাদেশীদের পদচারণা চোখে পড়ার মতো। সিটির বাংলাদেশী এলাকাগুলোতে দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, হালাল মিটের স্টোর গড়ে উঠেছে। আমেরিকা এমন এক দেশ বিশ্বের সবার পছন্দ এ দেশকে। সবার ধারণা, এখানে আসতে পারলে তার জীবনের পরিবর্তন ঘটবেই। সে পেয়ে যাবে সোনার হরিণ। তাই যে যেভাবে পারে এদেশে আসার জন্য বাড়িঘর, জায়গা-জমি বিক্রি করে বৈধ ও অবৈধ পথে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা এখানে কেউ না আসা পর্যন্ত অনুভব করতে পারে না।
বিশেষ করে গত বছর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার লোককে ভিজিট ভিসা দেয়া হয়েছে। ওদের মধ্যে শ’ শ’ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর থেকে শুরু করে শিল্পপতি আলেম-উলামা ও বড় বড় ব্যবসায়ী পরিবার-পরিজন রয়েছে। তারা যখন স্বশরীরে এখানে আসেন, তখন তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যখন বাস্তবে সবকিছু দেখেন তখন বলেন, আসলে এ রকম যে যন্ত্রণাদায় আমেরিকা হবে তা দেশ থেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। নিউ ইয়র্কের প্রবাসীরা বেশি অবস্থান করেন ব্রুকলিন চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, এস্টোরিয়া, জ্যামাইকা, জ্যাকসন হাইটস, কুইন্স উডসাইড, ওজোন পার্ক, ব্রুঙ্কস পার্কচেষ্টায় এলাকায়। বিত্তশালীদের অবস্থান লং আইল্যান্ডে। নিউ ইয়র্কে প্রায় ১৭/১৮টি বাংলা পত্রপত্রিকা রয়েছে। একমাত্র সাপ্তাহিক ঠিকানা ও বাংলা পত্রিকা ছাড়া বাকি পত্রিকাগুলো বিনা পয়সায় বিতরণ করা হয় বিভিন্ন মসজিদ ও দোকানপাটে। আর ফ্রি পত্রিকার অনেকগুলো মাঝে-মধ্যে বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়। তাই সবগুলো পত্রিকার নামের সঙ্গে পরিচিত নই। তবুও যেমন বাঙালি, প্রবাসী, আজকাল, দেশবাংলা, গণবাংলা, প্রথম আলো, বাংলাদেশ, পরিচয়, বাংলা টাইমস, রানার, জন্মভূমি, মুক্তকণ্ঠ। আর একটি মাত্র বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হলো টাইম টিভি। এসবের পাশাপশি দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শাখা রয়েছে। যেমন শীর্ষ দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরাম, মুসলিম উম্মা (জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন)।
সুপ্রিয় পাঠক, আপনাদের অবগতির জন্য বলছি, নিউ ইয়র্কে সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় বাংলাদেশীদের প্রথম পছন্দ এ শহর। বিশেষ করে এ শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনকে বলা হয় না-ঘুমানোর শহর। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা একই চিত্র, না ঘুমিয়ে থাকে ম্যানহাটন। ২ লাখ বাংলাদেশীর অধিকাংশই এ শহরে কাজকর্ম করে। এক জরিপে দেখা যায়, কাজের বেলায় শীর্ষে রয়েছে ইয়েলো ও গ্রীন ক্যাব চালনা, বড় বড় তারকা হোটেল থেকে নিয়ে ছোটখাটো রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড, রাজমিস্ত্রী, ট্রাফিক পুলিশ, গ্যাস স্টেশন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ফুটপাতে ভেন্ডারসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সর্বক্ষেত্রে সকল পেশায় জড়িত। ম্যানহাটনে দিনে ১০ হাজার হলুদ ট্যাঙি চলে। এর মধ্যে অর্ধেক ক্যাব চালক হবে বাংলাদেশী। বৃটেনে ইন্ডিয়ান কারি জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। সারা বিলাতে প্রায় ১৪/১৫ হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সে তুলনায় আমেরিকায় শূন্যের কোঠায়। ফুডের নামের তালিকায় সেরা দশে স্থান করতে পারেনি। এরপর নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকশ’ ছোট-বড় ফাস্টফুড ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে।
তবে নিউ ইয়র্কে যে কি পরিমাণ বিভিন্ন নামে সামাজিক সংগঠন রয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে নিয়ে প্রাম পর্যন্ত রয়েছে শ’ শ’ সামাজিক সংগঠন। প্রতিবছর ওই সব সমিতির মূল কাজ হচ্ছে সামার সিজনে দলবল নিয়ে পিকনিক, পথমেলা, শিশুমেলা, রমজান মাসে ইফতার পার্টি করা, দেশের মহান দিবসগুলোতে অনুষ্ঠান করা, আবার বড় বড় সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে দেশ থেকে অনেক অচেনা অজানা শিল্পী নিয়ে এসে কোটি কোটি টাকা কামাই করার নামে রমরমা আদম ব্যবসা। পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকার মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান এলে তাদের সঙ্গে বৈঠক অথবা মতবিনিময় অনুষ্ঠান ও গুটি কয়েক লোক দিয়ে তাকে সংবর্ধনার নামে ধন্য করা। আবার অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তুলে বিভিন্ন পত্রিকার প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ফোন করে ছাপানোর তদবির। আর ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও এমপিদের নিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গা দেখানো, ঘোরাঘুরি করা, দামি রেস্টুরেন্টে খানা খাওয়ানোসহ এমনও ঘটেছে যে, মন্ত্রী মশাই দেশ থেকে আসার সময় এক লাগেজ নিয়ে এলেন, যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে গেলেন ৫/৬টি লাগেজ। জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী মহোদয় বলেন, সংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থকরা ওইগুলো উপহার দিয়েছেন। না নিলে তাদের মনটা ছোট হয়ে যাবে। আর ওরা যখন দেশে যাবে তখন ঢাকায় গিয়ে মন্ত্রী ও এমপিদের কাছ থেকে মোটা অংকের ফায়দা হাসিল করবেই। এভাবে চলছে দেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থা।
বিজ্ঞ পাঠক, এখন আপনাদেরকে নিয়ে যাচ্ছি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটস-এ। আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন ওই এলাকায়। শ’ শ’ ব্যবসা-বাণিজ্য, হিজাব-বোরকা, কাফনের কাপড় থেকে এহরামের কাপড়, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, ট্রাভেল এজেন্টসহ সোনা, রুপা, বিয়ে-শাদী, বাজার-হাট, শাড়ি-গহনা, পাত্রপাত্রী দেখা, ইভটিজিং, ভিন দেশের বুড়াবুড়ি, যুবক-যুবতী, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, পুরুষ-মহিলা, নানা জাতের রেস্টুরেন্ট, সাদা-কালো, বাদামি রংয়ের লোক, খানাদানা আড্ডা দেয়া ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি সব কিছুই। দুষ্ট লোকেরা বলেন এক কথায় এটা সব দু’নম্বরী কাজের হেডকোয়ার্টার। বিশেষ করে শনি-রোববার বাইরের সিটি থেকে আসা লোকদের প্রচ- ভিড়ে চলাচল ও হাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য বাংলাদেশীদের কাছে এলাকাটা হচ্ছে শনি-রোববারের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এক খ- বাংলাদেশ।
’৮২ সাল থেকে লেখালেখি ও সমাজসেবায় জড়িত। তাই দেশ থেকে ১১ হাজার মাইল দূরে অবস্থান করলেও জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি দেশের কল্যাণ চিন্তা আমাকে তাড়িত করে সরাক্ষণ। শত ব্যস্ততার মাঝেও সিলেট বিভাগের ৩৮টি উপজেলার উন্নয়নে আমরা কয়েকজন সচেতন যুবক গঠন করি ‘সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি আঞ্চলিক সেবামূলক সংগঠন। এর মধ্য দিয়ে সব সময় আমি নিজেকে সোচ্চার রেখেছি। প্রবাসে আসা এমপি-মন্ত্রী, সচিব, চেয়ারম্যান, আবার কখনো রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে লবিং করে তাদের কাছে এলাকা তথা দেশবাসীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি। কোন সমস্যার সমাধান হয়েছে। কোনটা আশ্বাস পেয়েছি। কোনটি হয়তো আদৌ পূরণ হয়নি। আবার অনেকে কথা দিয়ে কথা রাখেননি। আমি দেশ ও জাতির উন্নয়নে আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছি। সিটির ম্যানহাটনে মদিনা মসজিদের পাশে যখন ছিলাম, তখন মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তে গিয়ে পরিচিত হই মূলধারার রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক হবিগঞ্জের হাসান আলির সঙ্গে। দীর্ঘ পথচলার পথে তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শীর্ষে। প্রবাসীদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে তার নেতৃত্বে ‘অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশী আমেরিকান’ নামে একটি সংগঠন চালু করি, প্রবাসী বাংলাদেশীদের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে শক্ত লবিং করে দাবিগুলো জোড়ালোভাবে পেশ করি। দাবিগুলো সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা আবার মাঝে মধ্যে এর ফলোআপ করি। সঙ্গে সঙ্গে সিলেট বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো দিয়ে লিফলেট তৈরি, বিভিন্ন গুণীজনের কাছে বিতরণ ও এর পক্ষে জনমত গঠন করি। প্রবাসে রুজি-রোজগারের পাশাপাশি এভাবে আমাদের কাজ আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। সিলেট বিভাগের প্রধান সমস্যা দ্রুত ব্যবস্থার ঘাটতি বা অনুন্নত যোগাযোগ।। এ ক্ষেত্রে তিনটি দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসি। যেমন সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক চার লেনে রূপান্তর, সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা সরাসরি মহাসড়ক নির্মাণ, সিলেট-আখাউড়া ডাবল রেল লাইন নির্মাণ। প্রধানমন্ত্রী এ ন্যায্য দাবিগুলো সম্পর্কে অবহিত আছেন। বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তবু দীর্ঘ এক যুগ পরও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই মন্ত্রী, এমপি আসলে রাস্তার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি বেশি করি।
সচেতন পাঠক মহল, আপনাদের অবগতির জন্য আরো বলতে চাই যে, পুরো নিউ ইয়র্কে যে হারে বাংলাদেশী বাড়ছে সে তুলনায় আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশ নেই বললেই চলে। সবাই আছেন দেশের দুই প্রধান দলের পচা-বাসী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কারণ সবার জানা দরকার, এ দেশীয় রাজনীতিতে আমরা যত বেশি জড়িত হবো, ভবিষ্যতে তত বেশি সুযোগ-সুবিধা আমাদের জন্য সৃষ্টি হবে। আর প্রবাসে দেশী রাজনীতি করলে হিংসা-বিদ্বেষ ও নোংরামি তত বেশি বাড়বে। তাই সময় থাকতে সাবধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত লোকদের দরকার এ মুহূর্তে এ দেশের মূল রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া।
এবার আমেরিকার কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরছি। পুরো আমেরিকায় ৩৩ কোটি জনগণ ৫০টি স্টেটসহ ৪৩৫ জন কংগ্রেসম্যান ও ১০০ জন সিনেটর যারা এদেশের আইন তৈরি করেন। সারা দেশে মোট জনসংখ্যার ৩০/৩২ শতাংশ হচ্ছে বহিরাগত ইমিগ্র্যান্ট। এর মধ্যে আরব এশিয়ান, আফ্রিকান ও স্প্যানিশের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি হিলারির মতে, মুসলিম সংখ্যা হচ্ছে ৭০ লাখ। আবার বড় বড় ইসলামী সংগঠনের মতো মুসলমানরা হলেন ১ কোটি। অধিকাংশ মুসলমান বাস করেন নিউ ইয়র্ক প্রায় ১ মিলিয়ন। মিশিগান, নিউজার্সি, শিকাগো, টেঙাস, ক্যালিফোর্নিয়া ফিলাডেলফিয়া ও ফ্লোরিডাতে। পাশাপাশি পুরো বিশ্বে ইহুদি বাস করে দেড় কোটি। এর মধ্যে তাদের দখলকৃত ইসরাইলে ৬০ লাখ, আমেরিকার ৬০ লাখ। ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও আর্জেন্টিনা মিলে বসবাস করে বাকি ৩০ লাখ। আর আমেরিকায় তারা বাস করে নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, টেঙাস ও ফ্লোরিডাতে। আমেরিকার এই মুহূর্তে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ। এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটিতে আছে প্রায় ছোট-বড় ২৫০টি। পাশাপাশি মুসলমানদের স্বার্থ দেখার জন্য রয়েছে ৩/৪টি বড় ইসলামী সংগঠন। যেমন ইসলামী সোসাইটি অব আমেরিকা, ইসলামী সার্কেল অব নর্থ আমেরিকা, কাউন্সিল অব আমেরিকা ইসলামী রিলেশন ও মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকা। শুধুমাত্র মুসলিম উম্মাহ বাংলাদেশী দ্বারা পরিচালিত। আর আমেরিকায় যে হারে মসজিদ বাড়ছে সে তুলনায় ইসলামী স্কুল ও মাদরাসা হাতে গোনা গুটিকয়েক। ছেলেমেয়েকে মসজিদমুখী করতে হলে তাকে প্রথমে দিতে হবে ইসলামী শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষা ছাড়া পরকালে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। আমার জানা মতে, তিনটি কওমি মাদরাসা রয়েছে দাওরা হাদিস পর্যন্ত। তা দারুল উলুম শিকাগো, দারুল উলুম মাদানিয়া বাফেলো ও দারুল উলুম জ্যামাইকা নিউ ইয়র্ক।
আগেও বলেছি আবারও বলছি, নিউ ইয়র্কে মুসলিম সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় লোকজন পরিবার নিয়ে আসছেন আবার অন্য ধর্মের তুলনায় মুসলিম পরিবারে জন্মহার বেশি। আর নিউ ইয়র্ক সিটিতে হালাল খাবার ও ব্যবসার নামে হাজার হাজার ভেন্ডার গড়ে উঠেছে। ওই ব্যবসা করতে সিটি মেয়র অফিস থেকে পারমিট নিতে হয়। ওই ব্যবসার শীর্ষে রয়েছে আরব মিসরীয়। তারা হালাল সাইনবোর্ড লিখে দিব্যি হালাল ফুড বিক্রি করছে। দেখলে মনে হয় নিউ ইয়র্ক সিটি হালাল খাবারের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে খাবারের সঙ্গে যে মাংস ও মুরগি সরবরাহ করা হয়, তা কতটুকু হালাল উপায়ে জবাই হয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ ভাল জানেন। আর এসব ভেন্ডারে হাজার হাজার মুসলমান আরব, আফ্রিকান ও বাংলাদেশীরা কাজ করে তাদের পরিবার চালান।
শেষ করার আগে বিজ্ঞ পাঠক মহলের কাছে সম্পূর্ণ একটি ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে লেখার ইতি টানবো। আমরা জানি, কোথাও কোন জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা আর সহজে কমে না। ’৮৫/৮৬ সালে দেশে ফোনে আলাপ করতে মিনিট প্রতি বিল আসে ২ ডলার ৫০ সেন্ট করে। আর লাইন পেতে হতো টেলিফোন কোম্পানির অপারেটরের মধ্যে। কোন কোন সময় বুকিং করার ২/৩ ঘণ্টা পরও লাইন পাওয়া যেতো না। তার কারণ, তখনকার সময় ঢাকার সঙ্গে সরাসরি কোন সার্কিট স্থাপন হয়নি। নিউ ইয়র্ক অপারেটর দিল্লির টেলি কোম্পানির সাথে কথা বলে ঢাকাকে দিতো। আর ঢাকা দিতো, সিলেট টিএন্ডটির মাধ্যমে। বেশ সময় দেশে কথা বলতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। তখনকার সময় কোন মোবাইল, ফ্যাঙ ও ই-মেইল আবিস্কার হয়নি। ইউএসএ’র ভিতরে এক সিটি থেকে অন্য সিটিতে ফোন করতে বিল আসতো প্রতি মিনিট ৫০ সেন্ট করে। আজ দীর্ঘ আড়াই যুগ পর ফোন সার্ভিস যে তড়িৎ উন্নত হয়েছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বর্তমানে পিএসসি মোবাইলের ৫০/৬০ ডলারের বিনিময়ে বিশ্বের শতাধিক উন্নত দেশে ফ্রি কথা বলা সহজ। আর নিজের ঘর থেকে ল্যান্ড ফোনে ৪০/৫০ ডলার বিল চার্জ দিয়ে আমেরিকা ও কানাডার আনলিমিটেড সময় কথা বলতে পারবেন। আর দেশের বেলায় চলছে সুবর্ণ সুযোগ। ফোন কার্ড দিয়ে যত খুশি তত কথা বলুন। প্রতি মিনিট খরচ পড়বে ২/৩ সেন্ট করে। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ ও টেকনোলজি কত দ্রুত হয়েছে তা বিশ্বাস করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। মিনিটেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খবর চলে যাচ্ছে। ঘরে বসে বিশ্বের নানা প্রান্তে যে কোন দুর্যোগপূর্ণ খবর মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছি। দুনিয়া আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে বিশ্বের বুকে আর কত রকমের চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কার হবে তা একমাত্র আল্লাহ পাক জানেন।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, হয়তো লেখাটি পড়তে পড়তে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। না এখনই লেখা শেষ করার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সমাপ্ত টানবো। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস হয়তো অনেকের কম বেশি জানা আছে। গত ৩০ বছরে আমার দেখা মতে এদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন ওবামা। তার কোন সফলতা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ঠান্ডা ভদ্র মেজাজের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এদেশে জনগণের মনে স্থান করে নিয়েছেন আর তিনি হচ্ছেন আমেরিকাসহ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের নয়ন মণি জিমি কার্টার। যা যুগ যুগ আমেরিকার জনগণ তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
ইনশাআল্লাহ, লেখার মাধ্যমে আবারো আপনাদের সাথে দেখা হবে। আপনাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি, সুদূর নিউ ইয়র্ক থেকে।
লেখক: গবেষক ও সমাজসেবক