রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন ভারতের মুসলমানেরা
ভারতের লোকসভা ও রাজ্য বিধান সভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব একেবারের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এ নিয়ে দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, কম প্রতিনিধিত্বের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তারা আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
রাজনৈতিকবিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই অনইসলাম নেটকে বলেন, একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক সমাজে সংখ্যা অনুপাতে সব সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব থাকবে বলেই আশা করা হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমানেরা ক্ষমতাসীন দল বিজেপি থেকে দূরে থাকায় আইনসভাগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব অনেক কমে গেছে।
ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থানে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলোতে মুসলমানদের প্রতিধিনিত্ব দ্রুত কমে গেছে। ভারতের ষোড়শ লোকসভার (পার্লামেন্টের নি¤œ পরিষদ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত মে মাসে। এ নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন। এ লোকসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব সর্বকালের সর্বনি¤œ ২২ জনে নেমে আসে। এর আগে ১৯৫৭ সালে লোকসভায় ২৩ জন মুসলিম এমপি ছিলেন।
এমনকি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ এলায়েন্স সরকারের আমলে লোকসভায়ও মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কম ছিল। সে সময় পঞ্চদশ লোকসভায় মুসলিম এমপি ছিলেন ২৮ জন। তার আগের পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যা ছিল ৩৪। ভারতের জনসংখ্যার শতকরা ১০.৫ ভাগ হলো মুসলমান, অথচ ৫৪২ আসনের লোকসভায় তাদের ২২ জন এমপি থাকায় তাদের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে মাত্র ৪.২ শতাংশ।
রাজ্য বিধানসভাগুলোতেও মুসলিম প্রতিনিধিত্ব দ্রুত কমে যাচ্ছে। মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে প্রায় চিত্রিত কংগ্রেস বেশির ভাগ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গেছে। বিজেপি জয়ী হয়েছে। এতে রাজ্য বিধানসভাগুলোতেও মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কমে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভারতে বেশ কিছুদিন যাবৎ এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। কিদওয়াই বলেন, ‘কিছু কাল যাবৎ এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। কারণ বিজেপি মুসলিম নেতৃবৃন্দ, কংগ্রেস বা অন্যান্য দলকে তাদের মাঝে স্থান দেবে বলে মনে হয় না। এর কোনো সহজ সমাধান দেখা যাচ্ছে না।
‘ফরমুলা ১৯৩৯’
এর কোনো সহজ সমাধান দেখা যাচ্ছে না। দেশ শাসনে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব প্রাপ্তিতে ব্যর্থতার ঘটনায় মুসলমানেরা যে উদ্বিগ্ন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাদের ধারণা, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে তাদের অপ্রতুল প্রতিনিধিত্বের অর্থ হলো তাদের সমাজ আরো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মুসলিম বিশেষজ্ঞ কামিল আহমদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি গণতন্ত্র অথবা সমাজের জন্য কোনো ভালো লক্ষণ নয়। আমরা সবসময়ই সঠিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি কিন্তু এবার লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা উভয় ক্ষেত্রে মুসলমান প্রতিনিধির সংখ্যা আরো অনেক কমে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানে আমাদের সঠিক প্রতিনিধিত্ব না থাকলে কে আমাদের কথা শুনবে?’
গত মাসে মুসলমানদের পক্ষে কর্মতৎপর ইউনাইটেড মুসলিম ফ্রন্ট (ইউএমএফ) ভারতের প্রেসিডেন্টকে লেখা এক চিঠিতে ১৯৩৯ ফরমুলা পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানায়। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রদানের লক্ষ্যে এ ফরমুলা প্রণয়ন করে। ইউএমএফ চেয়ারম্যান শহীদ খান দেশে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে একে দেশের নির্বাচন পদ্ধতির একটি ত্রুটি বলে অভিহিত করেন।
বিপুলসংখ্যক মুসলমান রয়েছে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেও একজন মুসলিম প্রতিনিধিও নির্বাচিত হতে পারেননি। উত্তর প্রদেশ রাজ্যে মুসলমানদের হার ১৮.৫ শতাংশ হলেও সেখানে একজন মুসলমানও লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। উত্তর প্রদেশের স্থানীয় মুসলিম নেতা রাজিব আলী বলেন, ‘ভারতীয় মুসলিম নেতাদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একবার নির্বাচিত হওয়ার পরই তারা সমাজের জন্য কোনো কাজ করেননি, ফলে তারা তাদের সমস্যা সমাধানে অন্য ধর্মের নেতাদের কাছে যেতে বাধ্য হতে হয়।’ তিনি আরো বলেন, সেকুলারপন্থী বলে দাবি করে এমন বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই কেবল ভোট পাওয়ার জন্য মুসলমানদের ব্যবহার করে।
বিজেপি শাসিত নয়টি রাজ্যের মধ্যে কেবল রাজস্থানে একজন মুসলিম মন্ত্রী আছেন। এতে মুসলমানদের ব্যাপারে দলটির চরম অবহেলার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। মুসলিম বিশেষজ্ঞ মুফতি শিস বলেন, ‘বিজেপি নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মুসলিমদের প্রার্থী করেছিল। বিজেপি মুসলমানদের ব্যাপারে যতœশীল এটি দেখানোর চেষ্টায় তারা দুই-একজন মুসলমানকে নির্বাচন করার টিকিট প্রদান করেছে। যেসব আসনে বিজেপি হারবে বলে জানত সেসব আসনেই তারা মুসলমান প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদান করে।’
আরেক মুসলিম নেতা আজম বেগ মনে করেন, ‘বিজেপির নীতিই হচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে বিভক্ত করা। তারা হিন্দু-মুসলমান ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষ এতটা ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, সেকুলারপন্থী হিন্দুরা পর্যন্ত মুসলমান প্রার্থীদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর অবস্থাও ভালো না। এমনকি কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি (এসপি), জনতা দলের মতো সেকুলারপন্থী দলগুলোও আরো আসন হারানোর ভয়ে মুসলমানদের মনোয়ন দেয়নি।’ সূত্র : ইসলাম অনলাইন