সর্বোচ্চ মূল্যে চিত্রকর্ম কিনে রেকর্ড সৃষ্টি কাতারের
মঈনুল আলম: মাত্র ২২ লাখ জন-অধ্যুষিত এবং অন্যতম ুদ্রতম আরব মুসলিম রাষ্ট্র কাতার বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ দাম দিয়ে পাশ্চাত্যের এক চিত্রশিল্পীর একটি চিত্রকর্ম কিনে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে! ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের ফরাসি শিল্পী সেজাঁর ‘কার্ড প্লেয়ার্স’ (তাস খেলুড়ে) নামে চিত্রকর্মটি ২৫০ মিলিয়ন ডলার (১৭৫০ কোটি টাকা) দিয়ে কিনে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যে একটি চিত্রকর্ম কেনার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে কাতার!
বিশ্বের আর্ট মার্কেটে প্রচলিত গোপনীয়তার কারণে কাতার এই চিত্রকর্মটি ২০১১ সালে কিনলেও এতকাল তা বিশ্বের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে এ তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি আরো জানা গেছে যে, কাতার বিশ্ব ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যে এই চিত্রকর্মটি কেনার আগে ২০০৭ সাল থেকে গোপনে পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পী ও আর্টিজানদের অনেক শিল্পকর্ম রেকর্ডমূল্যে কিনেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চিত্রকর্ম নিলামকারী অগ্রণী প্রতিষ্ঠান ফিলিপস্ অকশান হাউজের পরিচালিকা প্যাট্রিসিয়া হামব্রেখট নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘আর্টের মার্কেটে কাতার হচ্ছে এখন সবচেয়ে সম্মানিত ক্রেতা। চিত্রকর্ম কিনতে কাতার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, তা দেখে আমাদের মাথা ঘুরে যায়।’
এমন অকল্পনীয় উচ্চমূল্যে কাতার পাশ্চাত্যের শিল্পীদের চিত্রকর্মগুলো কিনছে কেন, তা পাশ্চাত্যের আর্ট মিউজিয়ামগুলো বুঝে উঠতে পারছে না। তবে এ তথ্যটি প্রকাশ হয়েছে যে, রেকর্ডমূল্যে চিত্রকর্ম কেনার পেছনে কাজ করছে কাতারের নতুন আমিরের সহোদরা শেখ আল মায়েসা বিনতে হামাদ বিন খলিফা আল সানির সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা।
২০০৬ সালে কাতারের তৎকালীন আমির তার মেয়ে শেখ আল মায়েসাকে কাতার মিউজিয়ামস অথরিটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন। তার পর থেকে তার নেতৃত্বে কাতারের রাজধানী দোহায় বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো তিনটি আর্ট মিউজিয়াম স্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব কাতার (নির্মাণাধীন), মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট এবং মাহতাফ নামে আরব মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট।
এই মিউজিয়ামগুলোকে সমৃদ্ধ করতে শেখ আল মায়েসা পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো যেকোনো মূল্যে কেনার জন্য নেমেছেন এবং এই কর্র্মসূচিতে তিনি বার্ষিক এক হাজার মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছেন, যা পাশ্চাত্যের অগ্রণী আর্ট মিউজিয়ামগুলোকেও লা-জওয়াব করে দিয়েছে! বিশ্বের সেরা আর্ট মিউজিয়াম নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট ২০১২ সালে চিত্রকর্ম কিনতে ব্যয় করেছে সাকুল্যে ৩২ মিলিয়ন ডলার। নিউ ইয়র্কের আরেকটি বিশ্বখ্যাত আর্ট মিউজিয়াম মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট একই বছরে চিত্রকর্ম কিনতে ব্যয় করেছে ৩৯ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বের আর্ট বাজারে শেখ মায়েসা এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী আর্ট ক্রেতায় পরিণত হয়েছেন!
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ২০১০ সালে দেয়া এক ইন্টারভিউয়ে শেখ আল মায়েসা বলেছিলেন, দোহাতে আর্ট মিউজিয়াম তিনটি স্থাপন করে মুসলিম সমাজ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের যেসব ভুল ধারণা আছে, তা তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা প্রায়ই বলতেন, শান্তি স্থাপন করতে হলে প্রথমেই আমাদের পরস্পরের সংস্কৃতিকে সম্মান জানাতে হবে।’ শেখ আল মায়েসা বলেন, ‘পাশ্চাত্যের মানুষ মধ্যপ্রাচ্যকে বোঝে না। তারা তাদের মস্তিষ্কের মাঝে ধারণ করা বিন লাদেনের চেহারার মধ্য দিয়ে আমাদের দিকে তাকায়।’
শেখ আল মায়েসা তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং চালচলনে পাশ্চাত্যের প্রভাবের সাথে মুসলিম প্রভাবের সংমিশ্রণ ঘটাতে চান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্স এবং লিটারেচার অধ্যয়ন করেছেন। চলাফেরায় তিনি পাশ্চাত্যের পোশাক এবং আরব মুসলিম মহিলাদের পোশাক, উভয় ধরনের পোশাকই যতেœর সাথে পরিধান করেন। ব্যবসায়িক বৈঠকে তিনি পাশ্চাত্যের মহিলা এক্সিকিউটিভের পোশাক পরেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি আরব মহিলাদের আব্র“সম্পন্ন কালো ‘আবায়া’ ধারণ করেন।
নিউ ইয়র্কের আর্ট ডিলার লেইলা হেলার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, শেখ আল মায়েসা অত্যন্ত শিতি মহিলা এবং তার একটি সুমহৎ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তিনি দোহাকে বিশ্বের চিত্রকর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে চাচ্ছেন, যাতে বিশ্বের বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো দেখার জন্য তার দেশের চিত্রামোদীদের নিউ ইয়র্ক অথবা প্যারিস কিংবা লস অ্যাঞ্জেলসে বিমানে উড়ে যেতে না হয়।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী