হাউস অব লর্ডসে বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনার
নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে লন্ডনে আয়োজিত বাংলাদেশ বিষয়ক এক সেমিনারে। এতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা অংশ নেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে সরকার সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছে বলে দাবি করেন।
বুধবার হাউস অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ: স্বাধীনতার ৪৩ বছর, উন্নয়ন, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও সংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। ৫ই জানুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নিয়ে তারা নিজেরাই ক্ষমতা গ্রহণ করেছে তাই এই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাব দূর করতে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে দ্রুত সংলাপ জরুরি। পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভবুরির সভাপতিত্বে সেমিনারে কো-চেয়ার ছিলেন অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান এ্যান মেইন এমপি। সেমিনারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন এমপি, তারানা হালিম এমপি, যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার আবদুল হান্নান। বিএনপির পক্ষে আরও বক্তব্য রাখেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সঞ্জীব চৌধুরী। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফায়েজ ও ক্যাম্পেইন ফর প্রটেকশন অব রিলিজিয়াস মাইনোরিটিস ইন বাংলাদেশের পুষ্পিতা গুপ্ত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিলো কিন্তু বিএনপি সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ) ও ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়নে (আইপিইউ) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এই সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন। ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ হয়েছে বলে তিনি সেমিনারে জানান। বিগত জোট সরকারের সময়ে শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, মন্দির জ্বালিয়ে দেয়ার বিষয় উল্লেখ করে এইচ টি ইমাম বলেন, বর্তমান সরকার উগ্রপন্থা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে সংসদে সেটা বাতিল হয়েছে।
পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভবুরি সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ধর্মীয় উগ্রপন্থা, জঙ্গিবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করার সুযোগ নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থায় সকলের সমান অধিকারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মত প্রকাশে স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পত্রিকার সম্পাদক ও টেলিভিশন মালিকদের সরকারি বাহিনী নানা রকম হুমকি দিচ্ছে। টকশোতে কারা যেতে পারবেন, কি বিষয়ে আলোচনা করা যাবে, সেটাও সরকার ঠিক করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত তারা ২০টি গুমের তদন্ত করেছে। এর মধ্যে ১১ জন নিখোঁজ ও ৯ জন নিহত হওয়ার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারসহ বিভিন্ন নিখোঁজ ও গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ক্যাম্পেইন ফর প্রটেকশন অব রিলিজিয়াস মাইনোরিটিস ইন বাংলাদেশের পুষ্পিতা গুপ্ত বিগত সময়ে জামায়াত-শিবির কিভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছিল তার একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন। তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জন্য জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে দায়ী করে ২০১৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি সুন্দরগঞ্জের ঘটনার বর্ণনা দেন। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখে বলেও তিনি মত দেন।
সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, সারা বিশ্ব চরম মন্দার মধ্যে থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬-৭ এর মধ্যে আছে। আমাদের জিডিপি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি বলেছেন, তিনি নিজে তদারক করে নিজেদের দলীয় পুলিশ বাহিনী দিয়ে ভোটের কাজ করেছেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভোটের সময় তাদের জন্য উজাড় করে দিয়েছে। তার এমন বক্তব্যই প্রমাণ করে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, সহ-সভাপতি সৈয়দ জালাল উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা প্রশান্ত বড়ুয়া, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুছ, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল হামিদ চৌধুরী, কনজারভেটিভ পার্টির এমপি পদপ্রার্থী মিনা রহমান, সাংবাদিক শাহিদা সৈয়দ প্রমুখ।