কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২
কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে তলানিতে ঠেকেছে বাংলাদেশের অবস্থান। ৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২। এর পর রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান, ইউক্রেন ও নাইজেরিয়া। আর বাংলাদেশের আগে ৭১তম স্থানে রয়েছে ইরান।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিউচারব্র্যান্ড প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ড ইনডেক্স ২০১৪-১৫’তে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত এ তালিকায় ৫০ ও শ্রীলংকা ৬০তম স্থানে রয়েছে। এছাড়া কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এ তালিকার ১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জীবনযাপনের ধরন, জীবনের মূল্য থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সবই একটি দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই শুধু পর্যটন, ইতিহাস বা ঐতিহ্যর ওপর ভিত্তি করেই সূচকটি প্রণয়ন করা হয়নি। এক্ষেত্রে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীবন ব্যবস্থাসহ সব ধরনের উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের শীর্ষে রয়েছে জাপান। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড, তৃতীয় জার্মানি, চতুর্থ সুইডেন ও পঞ্চম কানাডা। শীর্ষ ১০-এ যথাক্রমে রয়েছে নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও অস্ট্রিয়া।
শীর্ষ প্রতিটি দেশের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, ব্র্যান্ড ভ্যালু ও খ্যাতনামা কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের পণ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে একটি দেশের ব্র্যান্ড ভ্যালুর ক্ষেত্রে ছয়টি সূচকের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এগুলো হলো— ভ্যালু সিস্টেম, জীবনযাপনের ধরন, ব্যবসার সম্ভাবনা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, পর্যটন এবং মেইড ইন। এর মধ্যে প্রথম তিনটি সূচককে অবস্থা ও পরের তিনটিকে অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো মেইড ইন সূচকটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের সভাপতি শরিফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, কান্ট্রি ব্র্যান্ড ইনডেক্সে কান্ট্রি অব অরিজিন বা মেইড ইন— এ বিষয়টির মাধ্যমেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো ভালো অবস্থানে যাবে। কারণ তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ফুটওয়্যার, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধসহ বেশকিছু সম্ভাবনাময় খাত আছে, যেগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম আরো ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। তবে সুনাম বৃদ্ধি বা ইমেজ তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৌশলগত ঘাটতি রয়েছে। শিল্পসহ যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। তাই কৌশলগত ঘাটতিগুলো দূর করে বাংলাদেশের বাস্তবসম্মত প্রচারণা করা প্রয়োজন। তাহলে যে কোনো সূচকে সুসংহত অবস্থান তৈরি করা সম্ভব হবে।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত ছয়টি সূচকের প্রতিটির মধ্যে বেশকিছু উপসূচক বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভ্যালু সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে— রাজনৈতিক স্বাধীনতা, পরিবেশগত অবস্থা ও সহ্যশক্তি। জীবনযাপন ধরনের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার মান, নিরাপত্তা এবং দেশে অবস্থান করার আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্যবসা সম্ভাবনার সূচকের মধ্যে রয়েছে— ব্যবসা করার উপযুক্ত স্থান (গুড ফর বিজনেস), উন্নত প্রযুক্তি ও ভালো অবকাঠামো।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে— ঐতিহাসিক স্থানের গুরুত্ব, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পর্যটনের মধ্যে রয়েছে— মুদ্রার বিনিময় মান (ভ্যালু ফর মানি), আকর্ষণের মাত্রা, রিসোর্ট বা পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত আবাসন ব্যবস্থা, ছুটিতে ঘুরতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও রকমারি খাবার।
আর মেইড ইন সূচকের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে— তৈরিকৃত পণ্যের নির্ভরযোগ্যতা, উন্নত মানের পণ্য তৈরি, নির্দিষ্ট পণ্যের একক প্রস্তুতকারক ও কোনো নির্দিষ্ট দেশের পণ্য কেনার প্রতি আগ্রহ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সহ্যশক্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মান কিছুটা উন্নত হলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনেক পিছিয়ে। জীবনের নিরাপত্তা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে অবস্থাপন্নরা এ দেশে থাকার আগ্রহ হারাচ্ছে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও আধুনিক প্রযুক্তি ও অবকাঠামো প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
এছাড়া পর্যটক আকর্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি অযত্ন-অবহেলায় ঐতিহ্যগুলোও নষ্ট হতে বসেছে। আর সাম্প্রতিক বড় দুটি শিল্প দুর্ঘটনা দেশের ভাবমূর্তিকে অনেকটাই ক্ষুণ্ন করেছে।
পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘শিল্প দুর্ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এটা ঠিক। তবে এটাও ঠিক যে, পোশাক খাতের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এখন সুপরিচিত। আর এ খাতের সুনাম সুসংহত ও সুপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের মজবুত ব্র্যান্ডিংয়ের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি।
‘আমাদের প্রত্যাশা, পোশাক খাতের হাত ধরেই বিশ্বের যে কোনো ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারবে,’ বলেন আতিকুল।
১৭টি দেশের ২ হাজার ৫৩০ জন ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক পর্যটকের ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে ফিউচারব্র্যান্ড।
জরিপ চালানো দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
জরিপে বিবেচিত দেশগুলোর শক্তি (স্ট্রেনথ) ও গুরুত্বপূর্ণ শহর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এর ভিত্তিতে প্রভাবশালী ২০টি শহরের তালিকাও করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— নিউইয়র্ক, লন্ডন, বেইজিং, ওয়াশিংটন, মস্কো, টোকিও, প্যারিস, বার্লিন, সাংহাই, দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর, নয়াদিল্লি, সাওপাওলো, রিও ডি জেনিরো, লস অ্যাঞ্জেলেস, রোম, টরন্টো, সিউল ও মুম্বাই। আগামী তিন বছরে এ শহরগুলো প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।
প্রতিবেশী ভারতের দুটি শহর এ তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশের কোনো শহর এতে স্থান পায়নি।
সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত ৭৫টি দেশের মধ্যে ২২টিকে ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এসব দেশে পর্যটকরা অধিক পরিমাণে ভ্রমণে যান। ব্যবসার জন্যও এসব দেশ আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত।
এদিকে কান্ট্রি ব্র্যান্ড ইনডেক্সে ভবিষ্যতের ব্র্যান্ড হিসেবে পাঁচটি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশগুলো হলো— চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল ও কাতার। আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশগুলো ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে মনে করে ফিউচারব্র্যান্ড।
ব্যবসায়ীদের মতে, কান্ট্রি ব্র্যান্ড র্যাং কিংয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মেইড ইন অন্তর্ভুক্তির ফলে এমন সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এতে যেসব পণ্য বাংলাদেশ তৈরি করে তার যথার্থতা নিশ্চিত, ভালো মানের পণ্য উৎপাদন, সৃজনশীল মৌলিক পণ্য উৎপাদন এবং ভোক্তা পর্যায়ের পণ্য উৎপাদনকারী দেশের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের অবস্থান ভবিষ্যতে ভালো করা সম্ভব।