মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম ৩৫০০ কোটি টাকা পাচার
দীন ইসলাম: ১০ বছরে ২৩৭০ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়েছেন। এ সুবিধা পেতে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে মোটা অঙ্কের অর্থ জমা রাখতে হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশের সুযোগ গ্রহণকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বয়স ৫০ বছরের নিচে এমন কোন ব্যক্তির এ সুবিধা নিতে লাগছে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি টাকার বেশি। বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে সাড়ে তিন লাখ রিঙ্গিত বা ৮০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত এক অনুসন্ধানে দেখেছে, এসব অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছে সুবিধা গ্রহণকারীরা। এর বাইরেও কোটি কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় পাচার করে নিয়ে গেছেন তারা। এ কারণে গত কয়েক বছরে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণের দিক দিয়ে গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশীরা রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। বাংলাদেশের ঠিক আগে রয়েছে চীন। এ পর্যন্ত চীনের ৩২৬২ জন সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ২০৮৩ জন নিয়ে জাপান তৃতীয়, ১৮৭৯ জন নিয়ে যুক্তরাজ্য চতুর্থ, ১২০২ জন নিয়ে ইরান পঞ্চম, ৮৪৭ জন নিয়ে সিঙ্গাপুর ষষ্ঠ, ৭৬৫ জন নিয়ে তাইওয়ান সপ্তম, ৭৬১ জন নিয়ে পাকিস্তান অষ্টম, ৬৬৯ জন নিয়ে ভারত নবম এবং ৬৬৩ জন নিয়ে কোরিয়া দশম অবস্থানে রয়েছে। ওদিকে সরকারের মেয়াদ কমছে আর বাড়ছে বিদেশ পাড়ির হিড়িক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিবাজ ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর ব্যক্তিরা দেশের বাইরে নিরাপদ জায়গা খুঁজছেন। তুলনামূলক কম খরচে বাড়ি কেনা যায় বলে তাদের প্রথম পছন্দ মালয়েশিয়া। গত বছরে প্রথম ৮ মাসেই সেকেন্ড হোম কর্মসূচির ভিসা নেয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান আগের ছয় থেকে লাফিয়ে আবারও উঠে এসেছে দুই-এ। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। কোন সরকারের অধীনে হবে নির্বাচন তা নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। এ পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা শুরু করেছেন অনেকে। আর তাদের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে মালয়েশিয়া। গত দু’বছর অর্থাৎ ২০১১ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে সেকেন্ড হোম সুযোগ গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এর আগে ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশীরা। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে দ্বিতীয় আবাস গড়ার অনুমোদন নিয়েছেন ৩২৫ জন বাংলাদেশী। যেখানে ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল মোট ২৭৬ জন। তার মানে দেশের বাইরে আবাস গড়ার প্রবণতা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ২৭৬ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রোগ্রামের সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৮ জন, মার্চে ১১ জন, এপ্রিলে ২৬ জন, মে’তে ১৫ জন, জুনে ১৪ জন, জুলাইয়ে ৩০ জন, আগস্টে ১৫ জন, সেপ্টেম্বরে ২৯ জন, অক্টোবরে ৩১ জন, নভেম্বরে ১৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৪১ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। ওই বছর এ সুবিধা গ্রহণে বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ অবস্থানে। ২০১২ সালে বাংলাদেশীদের মধ্যে এ সুবিধা গ্রহণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ওই বছর ২৮৮ জন এ সুবিধা নিয়েছেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ২১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫২ জন, মার্চে ৫০ জন, এপ্রিলে ২৪ জন, মে’তে ৩৪ জন এবং জুনে ৫৪ জন সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এর আগে ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ব্যাপকহারে অনেকেই সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন। ওদিকে ২০০২ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়া ১৯ হাজার ১৬০ জনকে এ সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে ২০০২ সালে ৮১৮ জন, ২০০৩ সালে ১৬৪৫ জন, ২০০৪ সালে ১৯১৭ জন, ২০০৫ সালে ২৬১৫ জন, ২০০৬ সালে ১৭২৯ জন, ২০০৭ সালে ১৫০৩ জন, ২০০৮ সালে ১৫১২ জন, ২০০৯ সালে ১৫৭৮ জন, ২০১০ সালে ১৪৯৯ জন, ২০১১ সালে ২৩৮৭ জন এবং ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৯৫৭ জন। সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণের হার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত উত্তপ্ত হতে থাকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর মধ্যে ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮৫২ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এ পর্যন্ত ওই বছরই সর্বোচ্চ বাংলাদেশী এ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ২০০৬ সালে ৩৪১ জন ও ২০০৭ সালে ১৪৯ জন বাংলাদেশী এ সুবিধা নিয়েছেন। ২০০৬ সালে সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের মধ্যে প্রথম। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যে কোন দেশের নাগরিক মালয়েশিয়ার মাই সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এজেন্সি মারফত বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি এ প্রোগ্রামের সুবিধার জন্য আবেদন করা যাবে। এ জন্য ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত জমা রাখতে হবে। তবে দ্বিতীয় বছর অর্ধেক অর্থ তুলে নেয়া যায়। শুধু মালয়েশিয়া নয়, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতেও আশ্রয় খুঁজছেন অনেকে। আর এর আড়ালে ঘুরছে মুদ্রা পাচার। এর বেশির ভাগেরই কোন হিসাব পাওয়া যায় না। ওদিকে বছরে কত টাকা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে, তার কোন সঠিক হিসাব পাওয়া যাবে না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরগুলো পাঠ করলে এ সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। সম্প্রতি ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার নাম ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ২০০১-২০১০’। এতে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১৪ দশমিক ০৫৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ভারতের পরই বাংলাদেশের স্থান। ১৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। পৃথিবীতে যত দেশ থেকে টাকা পাচার হয়, তার মধ্যে ১০টি বড়। এর মধ্যে পাঁচটিই এশিয়াতে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চেষ্টা থাকলেও সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারীদের তথ্য যোগাড় করে মানিলন্ডারিং ঠেকাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে ব্যাংকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের দেশ থেকে কারা টাকা নিয়ে গেছে সেকেন্ড হোম করার জন্য এবং কি পরিমাণ টাকা নিয়েছে- সেটা আমাদের তারা বলেনি। তিনি বলেন, আমরা অন্যভাবে তৎপরতা চালাচ্ছি। দু’-একটাতে আমরা সফলও হচ্ছি। আইনগতভাবে যেহেতু এটা মানিলন্ডারিং হয়েছে তাই যদি আমরা জানতে পারি তাহলে সেটা দুদকের কাছে পাঠাবো।