সমকালীন বিশ্ব ও মুসলিম সম্প্রদায়
বিশ্বে মুসলমান জনজীবনের সামষ্টিক হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা নিয়ে অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করে থাকেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সপ্রতীভ অবস্থানের অনুপস্থিতিও অনেকের মন:পীড়ার কারণ হয়ে রয়েছে।
মুসলিমসহ সমস্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। অন্যান্য অমুসলিম দেশগুলোর আর্থিক-সামাজিক উন্নয়নযাত্রার ও মানসিক পরিপক্কতা অর্জন-যাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুসলিম দেশগুলো নিজেদের এগিয়ে নিতে পারছে না। কিন্তু শুধু তাই নয়, নিরন্তর আত্মকলহ ও পারস্পরিক বিনাশ তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে মুসলিম দেশগুলো একের পর এক নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে চলেছে।
একটানা শান্তি ও স্থিতিশীলতা মুসলিম দেশগুলো থেকে চিরতরে যেন বিদায় নিতে চলেছে। অমুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় সংখ্যালঘুস্বরূপ বসবাসরত মুসলমানরা বৃহৎসংখ্যক অমুসলিমের জীবনভোগের পাশে নিরাপত্তাবিহীন অসম ও উপেক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তাজ্জবের বিষয়, সাধারণভাবে হৃতদরিদ্র ও পরনির্ভর মুসলিম দেশগুলোর দুর্দশা লাঘবে ও তাদের জীবনে মানব-মর্যাদাবোধ ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য তুলনামূলকভাবে সম্পন্ন মুসলিম দেশগুলোর তরফ থেকে সামষ্টিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করণীয়স্বরূপ যে উদ্যোগ গ্রহণ প্রত্যাশিত ছিল তাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মুসলিম দেশগুলোর এই দুরবস্থার প্রাদুর্ভাব সাক্ষাৎ সমকালীন কোনো দুর্ঘটনা নয়। এই দুর্দৈব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোয় নেমে এসেছে বিগত আঠার শতকের শুরু থেকেই। প্রথম মহাযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে দুনিয়া জুড়ে ইউরোপ প্রবর্তিত মারণ ও ধ্বংস লীলার মধ্যদিয়ে মুসলমানের সর্বনাশার ষোলকলা পূর্ণ করা হয়েছে। অনুবীক্ষণিক গুটিকয় দেশ ছাড়া একটিমাত্রও স্বাবলম্বী মুসলিম দেশ বিস্তৃত বিশ্বে আজ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মুসলিম অমুসলিম সমাজের অনেকেই ভীষণ বিব্রত বোধ করে থাকেন যে, আট থেকে বারো শতকের মধ্যে বিদ্যা ও জ্ঞান আহরণের জন্য এবং স্রষ্টার দান বিপুল বিশ্বের স্বরূপ নির্ণয়ের তাগিদে সমুদ্র-পর্বত-প্রান্তর চষে বেড়িয়েছিলেন যে, মুসলমানরা। ১৬-১৭ শতক পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বিদ্যানিকেতনে মুসলিম মনীষী ও বিদ্বজ্জনক লিখিত গ্রন্থ পরম শ্রদ্ধায় ও নিষ্ঠায় গৃহীত ও পঠিত হতো তাদেরই পরবর্তী পুরুষেরা নিজেদের জীবন থেকে জঙ্গমতা এবং জিজ্ঞাসা-অনুসন্ধিৎসা বিসর্জন দিয়ে জীবন যাপনের বাহানায় নিঃসাড় গতানুগতিকতা চর্চার নামে এক বিশাল অনড় অচলায়তনে পরিণত হয়ে যেতে পারলেন কিভাবে? কোনো দেশ ধ্বংসের বা কোনো দেশ লুটের অভিপ্রায় সেদিনের মুসলমানরা অজানা-অচেনা বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমাননি। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে বিদেশী মানুষ তারা আপন বানিয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিরত থেকে জীবন অতিবাহিত করার অন্তে বিদেশের মাটিতেই নিজেদের নশ্বর শরীর মিটিয়ে দিয়েছেন।
ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত ও ইসলামের কঠোর নীতি চেতনায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত তাদের সেই জীবনবোধ ও বিশ্বাসে ১৩ শতকে বাগদাদে মঙ্গল আক্রমণে সৃষ্ট ধ্বংস বিপর্যয়ের পরবর্তীকাল থেকেই চিড় ধরতে শুরু করেছিল মনে করেন বহু মুসলিম বিশেষজ্ঞ। মনে হয় যথেষ্ট সত্য নিহিত রয়েছে তাদের ঐ পর্যবেক্ষণে। কিন্তু লক্ষণীয় সেই সময়েও অন্যত্র জাগতিক ও বাহ্যিক আড়ম্বরে ও বিশ্বাসে বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম দেশগুলোর কোথাও মালিন্য লক্ষ্য করা যায়নি। ১৬-১৭ শতক পর্যন্ত তুরস্কে ওসমানীয় সাম্রাজ্য, ইরানে সাফাভি সাম্রাজ্য ও ভারতে মোগল সাম্রাজ্য বিরাজমান ছিল দোর্দর্ন্ড প্রতাপে। ও সবগুলো অঞ্চল জুড়ে ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের চোখ ধাঁধানো সমাহারে দুনিয়ার বহুতর বণিক সম্প্রদায় এই সাম্রাজ্যগুলোয় অস্থির পতঙ্গের মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে বাংলা বিহার-উড়িষ্যার সম্পদ লুটের ও সেই সম্পদ বৃটেনে স্থানান্তরের ফলশ্রুতিতে ইংল্যান্ড যখন শিল্প বিপ্লবের সূচনা হচ্ছে। ভারতের মুসলিম শাসক মহলে ভবিষ্যৎ যন্ত্রযুগের আগ্রাসন সম্বন্ধে তখনও কোনো সাড়া সৃষ্টি হতে পারেনি- সত্যিই মুসলিম ইতিহাসের এ এক ট্র্যাজেডি বৈকি।
নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ও প্রয়োগে নিকটবর্তী ইউরোপীয় দেশগুলোয় যখন নবযুগের প্রবেশ ঘটে চলেছে, সে সময় সমকালের স্বরূপ ও তাগিদ উপলব্ধিতে ব্যর্থ তুরস্ক শতচেষ্টা সত্ত্বেও পুরনো কূটনীতি ও যুদ্ধকৌশল অবলম্বনের ফলশ্রুতিতে অসহায় চোখে সাম্রাজ্যের ক্রমপতন প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয়েছে।
মুসলিম শক্তি দমনে অমুসলিম বিশ্ব চিরকালই আশ্রয় নিয়েছে অন্যায় শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের। মুসলিম বিরোধী মহলে আজও যেন তেন প্রকারে মুসলমান ধ্বংসের লক্ষ্যে তৎপরতা অব্যাহত দেখা যাচ্ছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান দাবি করছেন, মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হলে মুসলমানদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কিন্তু ঘণ্টা বিড়ালের গলায় ঝোলাবে কে ও কবে ঝোলাবে?