ফাঁসি কার্যকরের নামে কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছে : অভিযোগ পরিবারের
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা যথেষ্ট আইনী সুযোগ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন তার বড় ছেলে হাসান জামিল। তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার ফাঁসি কার্যকরের নামে তার বাবাকে হত্যা করেছে।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির অডিটোরিয়ামে বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি।
কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের করে তার পরিবার।
হাসান জামিল বলেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে আসামির রিভিউ আবেদনের সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগ না দিয়ে তাকে (কাদের মোল্লা) হত্যা করা হয়েছে। আদালত থেকে রায় প্রকাশের ৩৪৮ দিন পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এর ১৫ দিন পর রিভিউ আবেদনের সুযোগ আছে। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। এমনকি তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের জানাজায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি এবং তার মুখও দেখতে দেয়া হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান ও তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের পূর্ণ বিবরণ
বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে কাদের মোল্লার বড় ছেলে হাসান জামিল বলেন, আমার বাবা শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এই সরকার ফাঁসি কার্যকরের নামে মূলত হত্যা করেছে। তিনি বলেন, আমার পিতাকে হত্যার ৩৪৮ দিন পর আপিল বিভাগ থেকে আমার বাবার দায়ের করা রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এই রায়ে রিভিউ ‘মেনটেনেবল’ বলে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়ের করতে হবে। অথচ আব্দুল কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সাত দিনের মাথায় তার ফাঁসি কার্যকর করা হলো। আমার বাবা দুনিয়া থেকে বিদায়ের আগে জানতেই পারলেন না সংবিধান অনুযায়ী তার রিভিউ করার অধিকার আছে কি না। যখন আইনের পূর্ণাঙ্গ আশ্রয় নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় তখন সেটা হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি আরো বলেন, এই সরকার আমার পিতাকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এমনকি সরকার আমার পরিবারের সদস্যদের আমার বাবার জানাযায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়নি। আমার বাবার মৃতদেহ শেষবারের মতো একনজর দেখারও সুযোগ দেয়নি। ওই রাতে একদিকে আমার বাবাকে হত্যা করা হলো, অন্যদিকে আমাদের পরিবারের উপর হামলা করা হলো, জেলে নেয়া হলো। এটা কতবড় জুলুম তা অবশ্যই দেশবাসী বিচার করবেন। আমি এদেশের মানুষের বিবেকের আদালতে এই সরকারের অন্যায় এবং জুলুমের বিচার চাই। আমি বিশ্বাস করি, আহ্কামুল হাকিমিন, মহান রাব্বুল আলামীন এই জুলুম এবং অবিচারের বিচার করবেন এবং আমার আব্বার শাহাদাত কবুল করে আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করবেন ইনশাআল্লাহ্।
আমি ন্যায়বিচার বঞ্চিত এক অসহায় পিতার সন্তান হিসেবে এই জুলুম এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই।
হাসান জামিল বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের লিখিত রায় প্রকাশের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাদের আইনজীবীগণ আমার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তিনি আইনজীবীদেরকে রিভিউ আবেদন দায়েরের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। আইনজীবীগণ ১০ ডিসেম্বর আমার বাবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে কারা ফটকের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ দায়ের-সংক্রান্ত বক্তব্য অবহিত করেন। গণমাধ্যমে সে সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
আমার বাবার নির্দেশনা মোতাবেক আইনজীবীরা রিভিউ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, রিভিউর সুযোগ নেই। রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আমাদের আইনজীবীগণ বার বার উল্লেখ করেছেন সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিভিউ দায়েরের সুযোগ আছে। আইনজীবীরা আরো বলেন, বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর আপিল বিভাগ তা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডে সাজা প্রদান করায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে অবশ্যই রিভিউর সুযোগ থাকা প্রয়োজন। এই ধরণের পরিস্থিতিতে গোটা দেশ ও জাতি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছিল।
১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে চিঠি দিয়ে পরিবারের সদস্যদেরকে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বলেন। পাশাপাশি সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে ওইদিন রাত ১২.০১ মিনিটে আমার বাবা জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
আমাদের আইনজীবীরা ওই আদেশ স্থগিতের জন্য চেম্বার জজের বাসায় ছুটে যান এবং সংবিধান অনুযায়ী আমার বাবার রিভিউ আবেদনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফাঁসির আদেশ স্থগিতের আবেদন করেন। মাননীয় চেম্বার বিচারপতি পরদিন সকাল ১০ টা পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকরের উপরে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। পরদিন আপিল বিভাগে ফাঁসি স্থগিতের জন্য ও রিভিউ এর জন্য আবেদন করা হয়। ওই দিনই আবেদনের উপর শুনানী শুরু হয়। পরদিন ১২ ডিসেম্বর আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং আমাদের উভয় আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। কোন গ্রাউন্ডে আমার বাবার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়। এটা আমার বাবাকে জানার কোনো সুযোগ দেয়া হলো না। আদালতে আবেদন খারিজ হওয়ার সাথে সাথে সরকার রাত ১০.০১ মিনিটে আমার বাবার ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণা দেয় এবং সরকার তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করে।
হাসান জামিল আরো বলেন, ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার জন্য সরকারের প্রতি জাতিসঙ্ঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু সরকার সেসব আহ্বান অগ্রাহ্য করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করে।
তিনি বলেন, আমরা আমার বাবাকেই শুধু হারাইনি, আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা, এক শিক্ষাবিদ এবং এক সমাজসেবক সর্বোপরি সাংবাদিক নেতাকে।
তিনি আরো বলেন, এই সরকারের অন্যায় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে যেসব দেশ, রাষ্ট্র, মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছেন ও আমাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, আমার আব্বার জন্য গায়েবানা জানাযার আয়োজন করেছেন আমি তাদের সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।