সিলেটে নান্দনিক শহীদ মিনারের উদ্বোধন
শুধু শহীদ মিনার নয়। এখানে রয়েছে স্মৃতিসৌধেরও নজরকাড়া মিশেল। যা দেশের মধ্যে প্রথম ও ব্যতিক্রম। আর নান্দনিকতায় দেশের অদ্বিতীয়। এখানে যেমনটা রয়েছে লালিমার লাল সূর্যের উপস্থিতি, তেমনি রয়েছে সবুজ ঘাসের মিশ্রনে বাংলার প্রকৃত রূপ। এরকম নন্দনশৈলীতে নির্মিত সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবারো যাত্রা শুরু করলো নবরুপে নব উদ্যমে।
শহীদ মিনারের নবযাত্রায় শুভ সূচনা করতে উপস্থিত হন সরকারের তিন প্রভাবশালী মন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী আর সাংস্কৃতি মন্ত্রী তিনজনই একই সুরে অভিন্ন ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, শহীদ মিনার হচ্ছে বাংলাদেশী জাতির প্রাণের মিনার। এ মিনার বাস্তবে ভাঙা যায়, কিন্তু বাঙালির মন থেকে এ মিনার কখনো ভাঙা যাবে না। তারা বলেন, বাঙালি জাতির মৌলিক চেতনা এখনো হারিয়ে যায়নি, মূল্যবোধও বিলিন হয়নি। কোন অশুভ শক্তির ক্ষমতা নেই জাতির এই মূল ভিত্তিকে ভেঙ্গে দিতে। এর প্রমাণ সিলেট শহীদ মিনারের নবরুপে ঐতিহাসিক যাত্রা। মন্ত্রীরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এটি হবে সিলেটবাসীর প্রাণের মিনার। তারা বলেন, ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যারা সিলেট শহীদ মিনারে তান্ডব চালিয়েছিলো তাদের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। বিচার থেকে তারা কখনো রেহাই পাবে না। তাদের বিচার কঠিন হবে বলেও হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন সরকারের এই তিন মন্ত্রী। মন্ত্রীরা বলেন, ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার। তাই কোন অশুভ তৎপরতা চালিয়ে সরকার কিংবা দেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করা যাবে না।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় শহীদ মিনারে একই সাথে পুষ্পস্তবক অর্পনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন তিন মন্ত্রী। পরপরই শুরু হয় উদ্বোধনী সুধী সমাবেশ। শহীদ মিনার বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক সদরুদ্দীন আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সমন্বয়ক সাবেক সিটি মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় জনারণ্য সুধী সমাবেশ।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সিলেট আদিকাল থেকেই একটি সমৃদ্ধ জনপদ। বাংলা সাহিত্যের সূচনা থেকেই মূল্যবান অবদান রেখে চলেছে সিলেটবাসী। ভাষা আন্দোলনের রক্ত ১৯৫২ সালে ঝরলেও সিলেটে ১৯৪৭ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। আর এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলো মুসলিম সাহিত্য সংসদ। তাই কোন দুষ্ট চক্র ষড়যন্ত্র করে হামলা চালিয়ে সিলেটের ঐতিহ্যকে ভাঙতে পারবে না। তিনি বলেন, এখনো আমাদের মৌলিক চেতনা, মূল্যবোধ হারিয়ে যায়নি। নবরুপে শহীদ মিনার বাস্তবায়নে সবার সমর্থন সহযোগিতা তাই প্রমাণ করে। অর্থমন্ত্রী শহীদ মিনারের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ৯০ সালে তিনি যখন প্রথম এটি পরিদর্শন করেন তখন তার ভালো লাগে আবার দুঃখও লাগে। কারণ এটি নির্মাণে যতœশীলতার অভাব ছিলো বলে তিনি মনে করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, সেই গৌরবের মিনার ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভাংচুর করা হয়। এরপরই এটি নতুন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করি। তিনি আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নতুন শহীদ মিনারের যাত্রাকে খুশির ঈদ উদযাপনের সাথে তুলনা করেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শহীদ মিনারে ভাংচুর করলেও অন্তরের শহীদ মিনারকে ভাঙতে পারেনি। নবরুপে শহীদ মিনার নির্মাণ করে সিলেটবাসী এর প্রমাণ দিয়েছে। তিনি বলেন, সিলেট এমন একটা অঞ্চল যেখানে আইয়ুব খানকে জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিলো। সুতরাং এই সিলেটে কোন অশুভ শাক্তি টিকে থাকতে পারবে না। এটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর নতুন শহীদ মিনার যাত্রার দিনকে অবিস্মরণীয় দিন উল্লেখ করে বলেন, এরকম দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার দেশে আর চোখে পড়েনি। এটি নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে অতুলনীয়। এটিকে নিয়ে সিলেটবাসী গর্ব করতেই পারে। অর্থমন্ত্রীর সৃজনশীল এই উদ্যোগের ভুয়শী প্রশংসা করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, এটি যে মর্যাদা নিয়ে তৈরী করা হয়েছে, এর মর্যাদা রক্ষা করাও সিলেটবাসীর কর্তব্য।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সংসদ সদস্য যথাক্রমে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, কেয়া চৌধুরী ও আব্দুল মতিন, সিলেট জেলা পরিষদের প্রশাসক আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান, সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, বিএমএ’র কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ডাঃ এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল, মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, জাসদ জেলা সভাপতি কলন্দর আলী, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ, গণতন্ত্রী পার্টির জেলা সভাপতি ব্যারিষ্টার আরশ আলী, জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম মন্টু, ওয়ার্কাস পার্টির সিকন্দর আলী, সাম্যবাদী দলের ধীরেণ সিংহ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ভবতোষ চৌধুরী, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমের সহধর্মীনী নাজনিন হোসেন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের অনুপ কুমার দেব, মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী প্রমুখ। সুধী সমাবেশে বিএনপি নেতা আবুল কাহের শমীমের নাম ডাকা হলেও তিনি উপস্থিত হননি। সুধী সমাবেশ শেষে দেশখ্যাত শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী সুবীরনন্দী, শুভ্র দেব, সেলিম চৌধুরী ও শাহীন সামাদ অংশ নেন। তাদের সুরের মুর্চ্ছনায় মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থেকে নবনির্মিত শহীদ মিনার।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ভাংচুর করা হয় একটি মিছিল থেকে। এরপরই এটি নবরুপে তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এটির কাজ শুরু হয়। শেষ হয় চলতি মাসের ৮ ডিসেম্বর। যদিও কমপ্লেক্স নির্মাণ এখনো বাকী বলে দাবী করেন সংশ্লিষ্টরা। শুভজিত চৌধুরী এন্ড এসোসিয়েটসের ডিজাইন ও কনসেপ্টে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। এটিতে থাকছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রহশালা এবং তিন হাজার আটশ বর্গফুট মিনি লাইব্রেরী।