গোষ্ঠীতন্ত্র ও সাহিত্যের সমাচার
ড. না সে র হো সে ন
লেখকদের নিজস্ব মতবাদ কিংবা মতভেদ থাকতেই পারে। চিন্তার বিভিন্নতা এবং প্রকাশশৈলীর ভেতর দিয়ে তৈরি হয় কবি-সাহিত্যিকের স্বাতন্ত্র্য। সাহিত্যের সাথে দর্শনের যোগাযোগও স্থাপিত হয়েছে ওই মতবাদের হাত ধরেই। গোষ্ঠীগত চিন্তা কিংবা দলগত ভাবধারাও সাহিত্যের বিকাশে অথবা প্রকাশে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। পরিবর্তন-ভাবনা, তারুণ্যের প্রকাশ, সমাজ-বিবর্তনকে রূপ দেয়া, কাঠামো বিষয়ে বিভিন্ন ধারণার আবির্ভাব, নতুনত্বÑ সব মিলিয়ে সাহিত্যের কারবারে সব সময়ই সাহিত্য-আন্দোলন বা গোষ্ঠীতন্ত্র কাজ করেছে ইতিবাচক ভূমিকায়।
আধুনিক বিশ্ব-সাহিত্যে আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতন্ত্র কিংবা ধারণাবাদের সাথে পরিচিত হই। রেনেসাঁ পরবর্তীকালে লেখকদের গ্রুপবদ্ধ কার্যক্রম আমাদের নজরে আসে। কখনো কখনো কোনো কোনো ধারণার সাথে ব্যক্তি-লেখকের নাম জড়িয়ে পড়ে। আবার কখনো বা দশক বা শতাব্দী পেরোনোর পর জানা যায় যে, ওই সময়ে কবি-সাহিত্যিকেরা দলগতভাবে একটি ধারণা কিংবা আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন। সতের ও আঠার শতকে রোমান্টিক রাইটারদের ‘অ্যামাটরি ফিকশন’ সম্ভবত প্রথম গোষ্ঠীগত সাহিত্যের ধারণার জন্ম দেয়। এরপর আবির্ভূত হয়েছে মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস, দ্য অগাস্টানস। ১৯ শতকের রোমান্টিসিজম, গোথিক নভেল, লেক পোয়েটস, ডার্ক রোমান্টিসিজম, রিয়েলিজম, ন্যাচারালিজম, সিম্বলিজম পৃথিবীময় খ্যাতি নিয়ে আজো বহাল রয়েছে। ২০ শতকে আসে অস্তিত্ববাদ, মডার্নিজম, দ্য লস্ট জেনারেশন, ডাডাবাদ বা এন্টি-আর্ট, সুররিয়ালিজম, সাউদার্ন অ্যাগ্রেরিয়ানস, ওলিপো, পোস্টমডার্নিজম, ব্ল্যাক মাউন্টেইন পোয়েটস, বিট পোয়েটস, হাঙরিয়ালিস্ট পোয়েটস, কনফ্যাশনাল পোয়েট্রি, নিউ ইয়র্ক স্কুল, ম্যাজিকেল রিয়ালিজম, পোস্টকলোনিয়ালিজম, প্রোকল্পনা মুভমেন্ট, স্পোকেন ওয়ার্ল্ড। ২০ শতকের শেষে এবং একুশ শতকের প্রথমপাদে নিউ ফরমালিজম এবং পারফরম্যান্স পোয়েট্রি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সাহিত্য-আন্দোলন কিংবা গোষ্ঠীতন্ত্র কোনো কোনো চিন্তা বা ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করলেও অন্তরালে কিন্তু ব্যক্তির চিন্তার বিকাশই সব সময় প্রাধান্য পেয়েছে। গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার চেয়ে ব্যক্তিই সাহিত্যে প্রভাব ও পরিচিতি নিয়ে হাজির থেকেছেন সর্বকালে। এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিরই জয়জয়কার। নোবেল প্রাইজসহ পৃথিবীর দামি-নামী সব পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করছেন ব্যক্তিÑ তার নিজস্বতা, নতুনত্ব ও ভিন্নতার জন্য।
বাংলা সাহিত্যে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাহিত্যচিন্তা ও মতবাদের ধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) কে ঘিরে একধরনের সাহিত্য-আন্দোলন আরম্ভ হয় বটে। কিন্তু গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রকৃত সাহিত্যধারা প্রবর্তিত হতে আমাদের ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’, ‘উত্তরা’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকার প্রকাশ (১৯২৩-১৯২৫) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কলকাতাকেন্দ্রিক ‘কল্লোলগোষ্ঠী’র সাথে একরকম পাল্লা দিয়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এই সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। পরে কলকাতা ও ঢাকাভিত্তিক সাহিত্যধারা এবং বিশেষত দশকওয়ারি, মফস্বল ও রাজধানীকেন্দ্রিক, দর্শন ও চিন্তাধারানির্ভর প্রভৃতি মোড়কের আড়ালে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে বাংলা সাহিত্যের গোষ্ঠিতান্ত্রিক বিচরণ, প্রকাশ ও বিকাশ। ষাটের দশকে ‘লিটলম্যাগ আন্দোলন’ও কিছুটা পরিচিতি পেয়েছিল বোধ করি। ‘প্রগতিশীলতা’, ‘আদর্শ’Ñ এসব স্লোগান কিংবা ভাবধারা লালনের কথাও প্রচার করে থাকে গোষ্ঠিকেন্দ্রিক সাহিত্য-আন্দোলন। ধীরে ধীরে এতে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। এসেছে সাম্প্রদায়িকতা। এতকাল পরে, এখন বোধহয় ভাববার সময় হয়েছেÑ সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বা গোষ্ঠিভিত্তিক এই সাহিত্যধারা আমাদের কী দিচ্ছে? সর্বনাশ ডেকে আনছে না তো?
বর্তমানে ঢাকায়, শিল্প-সাহিত্যের মঞ্চে ও অন্যান্য স্থানে এবং দেশের নানা প্রান্তে মতাদর্শ অনুযায়ী আয়োজিত হচ্ছে আড্ডা ও সমাবেশ। অন্য মতের কাউকে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয় না। কোনো কোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পক্ষও গ্রহণ করে ওই সব সাহিত্যসভা। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, লিটলম্যাগ, শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকা, বিশেষ সংখ্যা, ঈদ সংখ্যাÑ এসবে শুরু হয়েছে স্পষ্টত গোষ্ঠীবাদ বা সম্প্রদায়ভিত্তিক সাহিত্যসেবা! তৈরি হয়েছে ছোট ছোট সাহিত্য-সম্প্রদায়। প্রতিটি সাহিত্যপাতা কিংবা সাহিত্য-পত্রিকার জন্য যেন কয়েকজন লেখক নির্ধারিত হয়ে গেছেন। বছরজুড়ে ঘুরেফিরে তারাই লিখছেন। পত্রিকার নাম শুনলেই ধরে নেয়া যায় কারা কারা ওখানে লেখেন বা কোন কোন লেখকের লেখা ছাপা হয় ওই পত্রিকায়। কিছু সাহিত্য-পত্রিকায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিতে পারে অথবা পত্রিকায় কী কী বিজ্ঞাপন ছাপা হলো, তা দেখেও অনেকে অনুমান করে নিতে পারেনÑ পত্রিকাটি কোন ঘরানার। দু-একটি ব্যতিক্রম যে চোখে পড়ে না, তা কিন্তু নয়। তবে তা হাতেগোনা।
প্রকাশনা কিংবা করপোরেট হাউজও এই গোষ্ঠীতন্ত্রের লালন করছে নির্বিচারে। কে কাকে কেন কী পরিস্থিতিতে পুরস্কার প্রদান করছে, তা বুদ্ধিমান লোকেদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। সরকারি অনুদানপুষ্ট প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের অধিদফতর বা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলোও ওই গোষ্ঠীতন্ত্রের বা দলবাজির পুজো করতে পুরোদস্তুর অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের প্রভাবশালী কোনো মহল কালো টাকা সাদা করার জন্য আয়োজন করছেন সাহিত্য বা সংস্কৃতির সভা-সমাবেশ। কারো কারো নাম ব্যবহার করা হচ্ছে উপদেষ্টা প্রভৃতি পদবিতে। বিশেষ বিশেষ সাহিত্য পুরস্কারও তারা প্রদান করছেন ‘নিজস্ব ঘরানার বা গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের’ বাছাই করা লেখকদের। যেন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে এই ‘পক্ষপাতিত্বের’ প্রথা। হয়তো ভবিষ্যতে এই কালচারই আমাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়াবে। মনে প্রশ্ন জাগেÑ এই গোষ্ঠীবাদের তাঁবেদারি করে কিংবা লবিং-গ্রুপিং করে পুরস্কার-সম্মাননা গ্রহণ করে কি আমাদের সম্মান বাড়ছে? বর্তমান প্রজন্ম কিংবা ভবিষ্যতের নাগরিকদের কাছে কি আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য শক্তি-সামর্থ্য-সাহস অর্জন করছি আমরা?
প্রতিষ্ঠিত লেখকদের নিয়মিতভাবে জায়গা দিতে গিয়ে কিংবা নির্ধারিত লেখকদের লেখা নিয়মিতভাবে ছাপতে গিয়ে সাহিত্যপাতা বা সাহিত্যের কাগজগুলো এখন আর নতুন লেখক তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে পারছেন না। অথচ নতুন লেখক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কিছু নামি-দামী লেখক ছাড়া অপেক্ষাকৃত নবীনেরা লেখক-সম্মানীও ঠিকমতো পান না। কাজেই পাঠকেরা পাচ্ছেন না নতুন লেখার স্বাদ। সাহিত্যের বাজারে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মন্দা। বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক মন্দার সাথে আমাদের পরিচয় থাকলেও সাহিত্যের মন্দার সাথে বোধকরি খুব বেশি সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পারিনি এখনো। প্রবীণ লেখকেরা পাড়ি জমাচ্ছেন না ফেরার দেশেÑ কিন্তু সাথে সাথে আমরা কি প্রতিশ্রুতিশীল-সম্ভাবনাময় সাহিত্য-সাধকের সন্ধান বের করতে পারছি? বোধহয় না। মরে যাচ্ছে আমাদের সাহিত্যের কদর। বিশ্বসাহিত্য যেভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে আমরা তার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি কই! কোনো কোনো প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিশ্রুতিশীল লেখক প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে অবশ্য সাহিত্যের সেবায় নিয়োজিত আছেন। দেশকে পেছনে ফেলে তারা গ্লোবাল সিটিজেনের কনসেপ্টকে ব্যানারে টাঙিয়ে বাংলা সাহিত্যের ‘প্রসারে’ কাজ করছেন। সেখানেও হচ্ছে সভা-সমিতি। কিন্তু তাতেও লেগেছে গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রবল বাতাস। দলবাজি তাদেরকেও ছাড়েনি। দেশ থেকে ওইসব আড্ডায়-সভাস্থলে মাঝে-মধ্যে যোগ দিচ্ছেন দেশীয় ‘নিজস্ব সম্প্রদায়ের’ কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষক-সাংবাদিক-লেখক। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তারা তো প্রকৃত অর্থে ‘নিরাপদ’ ও ‘সুখী’ জীবনযাপনের জন্যই সমুদ্র পার হয়ে বাসা বেঁধেছেন। সেখান থেকে আমরা আর সাহিত্যের সমাচার কতটাই বা আশা করতে পারি।
এভাবে গোষ্ঠীতন্ত্র দিয়ে আর যা-ই হোক সাহিত্যের সেবা বা সাধনা কোনোটাই চলতে পারে না। আমরা যেন শুরু করেছি সাহিত্যের সর্বনাশা এক কারবার। এই কারবারে বাণিজ্য আছে, বিশেষ রকম প্রচার আছে। কারো কারো বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালাভের সুবর্ণ সুযোগও আছে। রাজনীতি আছে। বাম ঘরানা আছে, ডান ঘরানা আছে। আদর্শ-আদর্শ বলে প্রচার আছে। ‘প্রগতিশীলতা-প্রতিক্রিয়াশীলতা’ বলে উচ্চকণ্ঠ বক্তৃতার বাহার আছে। কিন্তু সাহিত্যের তাতে কী লাভ? সাহিত্যে কী হচ্ছে? সব কিছুকে আড়াল করে, সাহিত্যের নাম ভাঙিয়ে আমরা বোধহয় রাজনীতি করছি। সাহিত্যের মোড়কে সৃষ্টি করে ফেলেছি কতেক রাজনৈতিক দল, জোট বা গোষ্ঠীর ‘অঙ্গসংগঠন’ বা সরাসরি কোনো ‘সহযোগী সংগঠন’।
বাংলাদেশের সাহিত্যসভায় গোষ্ঠীতন্ত্র বা গ্রুপিং-লবিং জেঁকে বসে যে প্রকৃত অর্থে সাহিত্যেরই শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ এ কথা সম্ভবত সব সচেতন মানুষ মানবেন। কিন্তু কথা হলো, এর থেকে পরিত্রাণ কী? সমাধান তো একটা কিছু বের করতে হবে। সাহিত্যের আড্ডা তো আর থেমে থাকবে না। আবার রাজনীতি-সমাজনীতি থেকেও সাহিত্যকে একেবারে আলাদা করা যাবে না। তাহলে উপায়? উপায় হলো গোষ্ঠীতন্ত্র বা মতবাদগত বিভাজন কিংবা রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতাকে সাহিত্যের আড্ডার টেবিল থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীতিগত চেষ্টা শুরু করা। সাহিত্য অবশ্যই রাজনীতির পরিবর্তনে ও পরিশোধনে কাজ করবে। কিন্তু কাঠামোতে রাজনীতির মোড়ক যেন না থাকে। কিন্তু কথা হলো কে শুরু করবে এই ‘নির্দলীয় সাহিত্যসভা’র আয়োজনÑ যেখানে দল-মত-মতবাদ-সম্প্রদায় প্রভৃতি চিন্তাকে দূরে রেখে সব কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী মিলিত হবেন এক সমাবেশে? একবার তো উদ্যোগ নিয়ে দেখা যেতে পারে। যে কেউ করতে পারেন এই প্রাথমিক কাজটি। বেশি উদ্যোক্তার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি সূচনা করতে পারে নবতর ও চিরন্তন ‘সম্প্রদায়মুক্ত’ সাহিত্য-সভার। ধীরে ধীরে এই ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং তার কার্যক্রমও সম্প্রসারিত হবে। তখন সত্যিকারের উপকার হবে সাহিত্যের। মন্দার বাজার অতিক্রম করে হয়তো একদিন সাহিত্য পাবে তার কারবারের সুন্দর-স্বাভাবিক পরিবেশ।