আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম
আনোয়ার পাশা
১৯৫২-র দিকে সাময়িকপত্রে ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’ প্রকাশিত হলে আমাদের কথাসাহিত্যে একটি নতুন নাম সেদিন সংযোজিত হলো_ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একটি প্রাচীন সামন্ত পরিবারের অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার একমাত্র বংশধর ইউসুফ চৌধুরীকে পাঠানো হচ্ছে শহরে। সেখানে কেবলি সে কি বিদ্যাচর্চা করবে? অবশ্য উদ্দেশ্য তাই ছিল। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে আগমন তো কেবলি একটি সাধারণ ঘটনা হতে পারে না_এ যেন, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে যথার্থ যে, সামন্ত-যুগ অতিক্রান্ত হলে স্বাভাবিক যুগধর্মের তাগিদে ধনতান্ত্রিক-যুগে উত্তরণ। ধনতান্ত্রিক সভ্যতাকে রবীন্দ্রনাথ এক স্থানে ‘শোষণজীবী-সভ্যতা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথমে তার লালন ও বিকাশ হয় নগরে, অতঃপর তার থাবা প্রসারিত হয় গ্রামগুলোর দিকে_ গ্রামের মানুষ তখন একটি দুটি করে এসে তার জঠরানলে আত্মাহুতি দেয়। ‘নাম-না-জানা ভোর’-এর আলম তেমনি একজন গ্রামের মানুষ। যুগধর্মের টানে ছিটকে এসে পড়েছে শহরে। নাসিমাও অনেকটা তাই। তারপর সেখানে তাদের জীবনের পরিণতি কী? আলমের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ধনতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মধ্যবিত্তের আপন স্থানটুকু কোনোমতে খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম। ‘শেষ রজনীর চাঁদ’ও এমনি নিম্ন-মধ্যবিত্তের কোনোমতে স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার কাহিনী। পরিশেষে ‘নীল যমুনা’।
ছোটগল্পের বই তাঁর এ পর্যন্ত তিনটি_ ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘সম্রাটের ছবি’ এবং ‘সুন্দর হে সুন্দর’। গ্রাম ও নগরজীবনের পটভূমিকায় বিভিন্ন গল্পের লেখকের সমাজ-চেতনার সঙ্গে আধুনিক মনস্তত্ত্বসচেতন শিল্পরীতির প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি। ইতিহাস চেতনাও দুর্নিরীক্ষ্য নয়। তবে আমার মনে হয়েছে, উপন্যাসগুলোতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যেমন মূলত সমাজসচেতন এবং সেইখানেই তাঁর বিশিষ্টতা, তেমনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে; পক্ষান্তরে তিনি মূলতই মনস্তত্ত্বসচেতন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যসচেতন, এদের পরিমাণ কিংবা ব্যাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন, উভয়ত প্রায় সমান সমান।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পর্কিত প্রথম অনুসন্ধান-কার্যে আমাকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর গ্রন্থের নামগুলো। একটি প্রবন্ধে একবার পড়েছিলাম_ আমাদের আলোচ্য এই লেখকটি সম্পর্কে, ‘রোমান্টিকতার চোরাবালিতে’ নিমজ্জনের অভিযোগ সেখানে উত্থাপিত হয়েছিল (বাংলা একাডেমি পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৪, পৃ. ৭৪)। অভিযোগ সত্য হতেও পারে এবং রোমান্টিকতা সম্পর্কে আমার ধারণা যতই পড়েছি ততই অস্বচ্ছ হয়েছে যদিও, কিন্তু বর্তমানে আমি তবু সুনিশ্চিত যে, রোমান্টিকতার অভিযোগ তাঁর সম্পর্কে অনেকটাই তাঁর গ্রন্থের নামগুলোর জন্য। এবং তাই যদি হয় তা হলেও তো প্রশ্ন তোলা চলে_ রোমান্টিকতা মানেই কি চোরাবালি? কিন্তু এ কথা এখানেই থাক। অজ্ঞাতেই কখন বিশাল তর্কের সিংহদরজায় উপনীত হয়েছি। এখানে মীমাংসায় অবতীর্ণ হয়ে সুকৌশলে মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যায় বটে, কিন্তু আমি তাতে অনিচ্ছুক। আমাদের সরাসরি বক্তব্যটুকু ছিল এই সকল গ্রন্থের নামকরণের মধ্যে লেখকের কোনো মানস-পরিচয় কারও কারও কাছে অনুসন্ধানযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। নাম-পরিক্রমায় অবতীর্ণ হলে কী দেখি আমরা?
শেষ রজনীর চাঁদ, নাম-না-জানা ভোর_ দুটি নামই নতুনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সেই ইঙ্গিতের বিশেষ চরিত্র আছে। আমাদের সামনে নতুন উষার জলমগ্ন রাত্রিশেষের ক্ষীয়মাণ চাঁদের ম্রিয়মাণতা-বিজড়িত। চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যানের ইসহাক চৌধুরী, সম্রাটের ছবির একনিষ্ঠ সর্বশেষ ভক্ত খানবাহাদুর উমর আলী প্রভৃতি আমাদের সমাজের সেই ক্ষয়ী চাঁদ_ কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। এদের অবলুপ্তি এখন অবশ্যম্ভাবী। এই অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে নতুন উষার আবির্ভাবকে প্রত্যক্ষ করতে চাওয়ার অভীপ্সা নাম-না-জানা ভোরের আলম ও মিলির মধ্যে ব্যঞ্জিত। আলমের রাত্রি-পরিকীর্ণ জীবন নাম-না-জানা ভোরের সন্ধান পেয়েছে একটি ছিন্নমূল পরিবারের একজন মিলির মধ্যে। শেষ রজনীর চাঁদের ব্যঞ্জনা কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র, কিন্তু প্রসঙ্গচ্যুত, অতএব অন্য সম্পর্কিত নয়। প্রাক-সূর্যোদয়লগ্নে কৃষ্ণপক্ষের শেষ রজনীর চাঁদের ম্লানতা নিয়ে যে অসংখ্য নিম্ন-মধ্যবিত্ত নগরজীবন আপনাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত, তাদের কাহিনী শেষ রজনীর চাঁদ। এতদ্ব্যতীত লেখকের একাধিক রচনায় অরুণোদয়ের পূর্বক্ষণে প্রথম-ঔজ্জল্য-প্রাপ্ত আকাশের তাৎপর্য বহু বর্ণনার সাক্ষাৎ মেলে।
অতঃপর লক্ষ্য করুন সম্রাটের ছবি নামটি। ইংল্যান্ডের রাজা স্বদেশে তাসের রাজার মতো হয়েও তাঁদের সেদিনের উপনিবেশগুলোতে ছিলেন মধ্যযুগীয় স্মৃতি ও সম্ভ্রমের প্রতীক। কারণ স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে মধ্যযুগ আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৪৭-এর আগে নয়। সাতচলি্লশের পর কেবলি ইংল্যান্ডীয় সম্রাটের দিন শেষ হয়নি; আমাদের সমাজবক্ষ থেকে বিদূরিত হয়েছে সামন্তযুগীয় জগদ্দল পাষাণভার। অতএব পঞ্চাশের যুগের প্রথমদিকে সাহিত্য-ক্ষেত্রে-আবির্ভূর্ত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সময়ের বিচারে যুগসন্ধিকালের সাহিত্যিক। সেই যুগসন্ধিকালে তখনও একশ্রেণীর খানবাহাদুর-রায়বাহাদুর লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি যে, সযত্নে আপন বক্ষে লালন করেছেন সম্রাটের ছবি-সামন্ত যুগের ঐতিহ্য ও স্মৃতি। কিন্তু তাদের এ লালন প্রয়াস যে ইতিহাসের ধারায় ব্যর্থ হতে বাধ্য, সে তো আমরা ইতিহাস-সচেতন না হয়েও বলতে পারি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একাধিক রচনায় আমরা এমনি সামন্তশ্রেণীর নর-নারীর সাক্ষাৎ পাই যাঁদের মধ্যে সদ্য বিগত দিনগুলোর স্মৃতি সযত্ন-সঞ্চিত, কিন্তু চারপাশের পরিবর্তিত আবহাওয়ার ঘেরাটোপের মধ্যে মুমূর্ষু-দশাপ্রাপ্ত, অথবা যেন করুণানগরের উদ্ভিন্ন-চেতনায় দীপ্ত জীবনপ্রবাহের মধ্যে যেন প্রস্তরীভূত ক্লিওপেট্রা ক্যাস্ল্।
গ্রন্থের নাম প্রসঙ্গেই আরও লক্ষণীয়, লেখকের চিৎপ্রকর্ষ প্রকৃতিবিরূপতার পথে নয়, যদিও উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতি-বর্ণনার প্রাক্তিরিশ যুগের রেওয়াজটি যে একালে আদ্যন্ত অচল, সে জ্ঞান লেখকের মধ্যে পুরোপুরি। বস্তুত আধুনিক সাহিত্য প্রকৃতি পরিত্যক্ত. এমন কথা একালের কথাসাহিত্যের উদাহরণ সামনে রাখলেও কিছুতেই নিঃসংশয়ে বলা চলে না; কাব্যসাহিত্যের তো কথাই নেই। প্রকৃতি-জগৎকে বাদ দিয়ে মানুষের জীবন কোনোকালেই সম্পূর্ণ ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না_ অতএব সাহিত্যের সীমানা থেকে প্রকৃতির নির্বাসন উচিত কি অনুচিত এমন তর্ক বোধহয় একালেও অচল। সচল যেটুকু তা হচ্ছে প্রস্তুতির ব্যবহার নিয়ে কথা। প্রকৃতি-ব্যবহারে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মৌলিক না গতানুগতিক_ প্রশ্ন ওঠানো চলে সেইখানে। কিন্তু এ প্রশ্ন অপেক্ষাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ যা মনে হয়েছে তা হচ্ছে, নাগরিক অভিঘাতের প্রথম ধাক্কায় এবং প্রথম ধাক্কাতেই যেটা স্বাভাবিক, তাঁর সাহিত্য সরণি বৃক্ষপত্রশূন্য বা আকাশের নীলিমা বর্জিত হয়ে কেবলি দু’পাশে ইট-কাঠ-পাথরের সনি্নবেশ হয়ে ওঠেনি।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর তৃতীয় গল্পগ্রন্থের নাম সুন্দর হে সুন্দর। ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর’_ রবীন্দ্রনাথ যাঁর সঙ্গ লাভ করেছিলেন অতিসামান্য। আমরা তুমুল কোলাহলের যুগে বাস করে তার নাগাল পাব না। কিন্তু তা হলেও, কবির ভাষাতেই বলি, ধরাতলে দীনতম ঘরে আবির্ভূত বালিকার সঙ্গলাভে সুন্দরের অমৃতস্পর্শ কি একান্তই অকল্প? না তা হতে পারে না_ শেষ রজনীর চাঁদ ও নাম-না-জানা ভোর দুটি উপন্যাসেরই এই হচ্ছে জবাব। শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও প্রেম ও পারস্পরিক সহযোগিতায় গড়ে ওঠা সংসারে নারী-পুরুষ পরস্পরের মধ্যে সুন্দরের সঙ্গে লাভ করে_ এ বিশ্বাস যেমন সদ্য-উলি্লখিত উপন্যাসদ্বয়ে ব্যক্ত হয়েছে তার শেষতম গল্পগ্রন্থের নামকরণেও।
এইভাবে গ্রন্থের নাম-পরিক্রমা থেকেই আমরা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাহিত্যকর্মের কয়েকটি প্রধান কথার সূত্র নির্মাণ করতে পারি। প্রথমত, এখন কৃষ্ণপক্ষের পৃথিবী ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের প্রহরগুলো গণনা করছে মাত্র। অতএব দুঃসময় হলেও সেটা হতাশায় স্থবির নয়, সামনেরই নাম-না-জানা ভোরের বর্ণাঢ্য জাগরণ-লগ্ন প্রতীক্ষমান। দ্বিতীয়ত, ইতিহাসচেতনা (তার একটি গল্পের নামও ‘ইতিহাস’) আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে স্থান-কাল ও ঐতিহ্য বিষয়ে সজাগ, অতএব আধুনিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। তিনি উদ্ভিন্ন যুগ-চেতনার শিল্পী, ক্রান্তিকালের রূপকার। তৃতীয়ত, আধুনিক যুগের নগরমুখিতা তাকে সৃষ্টিক্ষেত্রে নগর-সচেতন করলেও প্রকৃতিচেতনা তার শিল্পীসত্তায় অনুপস্থিত নয়, বরং তার সক্রিয় উপস্থিতি তার সৃষ্টিকে একটি রুচিকর ও তৃপ্তিদায়ক এবং সেই সঙ্গে ব্যঞ্জনাধর্মী অবয়ব প্রদান করে থাকে। চতুর্থত, দুঃখ-ক্লেশ-গ্গ্নানি সত্ত্বেও আটপৌরে দৈনন্দিন জীবন কখনোই শুধু কদর্য ও কুশ্রী নয়- এ বিশ্বাসের বৃত্তে তার কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি তাকে এই বিভ্রান্ত যুগেও নিছক অমঙ্গলবোধের অর্থাৎ পাপ ও দুঃখবোধের শিল্পী করে রাখেনি। তিনি বিমূঢ় পরিবেশেও সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভয় পাননি।
এই চারটি সূত্রের প্রত্যেকটি ধরে বিস্তৃত আলোচনায় অগ্রসর হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আমি এখানে সেই সুযোগ-গ্রহণ অপেক্ষাও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচনাকে কেন্দ্র করে আমার চিত্তের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে উদ্যোগী হচ্ছি একটু বিশেষ কারণে। এই সায়াহ্নের সুধী-সমাবেশে একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই- আমরা সাহিত্য পড়ব কেন? না, এর দ্বিতীয় কোনো উত্তর জীবন ক্ষমা করবে না। আমার মতে, একটি মাত্র উত্তর ছাড়া, সে হচ্ছে- বাঁচার প্রয়োজনে। মানুষের বাঁচার প্রয়োজনে যে-সাহিত্যের কোনো উপযোগিতা নেই সে-সাহিত্য পৃথিবীতে, আর যাই হোক সুস্থ মানুষের কাছে কখনও অভিনন্দিত কিংবা গ্রহণযোগ্য হবে না। কিছু মানুষ চিরদিনই সমাজে থাকতে পারে যারা আত্মহত্যা করতে বা অমঙ্গল চেতনায় আবিষ্ট হয়ে সর্বত্রই সাদা দেয়ালে কালি বুলাতে তৃপ্তিবোধ করবে। তেমন মানুষের রায় কোনো সমাজে মেজরিটি পেলে সেটা সমাজের, সহস্র ঢক্কানিনাদে প্রগতিলক্ষণ বলে জাহির করা হলেও আসলে তা চরম দুর্দিনের চলচ্চিত্র ছাড়া কিছু নয়। সাহিত্যিকমাত্রেই কিছুটা অসুস্থ মানুষ বা এক্সেনট্রিক অথবা, কথাটা ঘুরিয়ে বললে, সাহিত্যিক হতে গেলে কিছুটা অসুস্থতাকে লালন করতেই হবে_এমন মতবাদে আস্থা স্থাপন কোনো কোনো বোদলেয়ার-ভক্তের চরম কাম্য হতে পারে; কিন্তু বোদলেয়ারের সিফিলিস অনুকূল সামাজিক আবহাওয়াতে আজ বংশবৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে বলেই তাকে বাধা দেওয়ার কোনো দায় কারও নেই, সে কথাই-বা মানি কী করে? যেহেতু আজ অন্ধগলির প্রতাপ বেড়েছে, অতএব পাঠককে ধরে ধরে অন্ধ গলিতে চালান করে দেওয়াই হবে সাহিত্যিকের কাজ_ এমন বিশ্বাসে আস্থা স্থাপন মানবতার কাছে বেইমানি এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার সৃষ্টিক্ষেত্রে কোনো অবিস্মরণীয় শিল্পী হবেন কি-না সে বিচারের ক্ষমতা আমি রাখি নে। কেবল এটুকু উপলব্ধি করে পরম তৃপ্তিবোধ করেছি যে, গল্প-উপন্যাস সর্বত্র, আমি যেহেতু বাণবিদ্ধ ক্রৌঞ্চের হাহাকারবেষ্টিত। অতএব, একটা যে স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছি সেটা সর্বকালের পণ্ডিতের বিচারে কতখানি কী জানি নে, আমার কাছে তো রীতিমতো স্বস্তি ও ঈর্ষাযোগ্য বিষয় বলে অনুভূত হয়েছে। শেষ রজনীর চাঁদে এক উঠানে বারো ঘরের মতো যেসব পরিবারের সমাবেশ লেখক ঘটিয়েছেন আধুনিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত নগরজীবনের কোন অভিশাপটি তাদের জীবনে নেই? বুর্জোয়া সমাজের স্টম্ফীতি মধ্যবিত্তদের অনেককে জাতিচ্যুত করে প্রোলেটারিয়েট-স্তরে নিক্ষিপ্ত করে_সেই সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক সমাজচেতনা যেমন এ উপন্যাসে সঞ্চারিত তেমনি এ কথাও উহ্য থাকেনি যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রীতি দিতে তবু আমাদের বাঁচার সাধনা করে যেতে হবে। হ্যাঁ, এ সম্পর্কে একটি কথা অবশ্যই উঠতে পারে যে, উক্ত সিদ্ধান্তের শেষাংশটুকু লেখকের বাসনাসঞ্জাত। কথাটা মানবো এবং সঙ্গে সঙ্গে এও বলব যে, তনি্নষ্ট বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাসনালোকের আত্মপ্রতিষ্ঠার যথার্থ সংযোগ শিল্পীকে অন্তত জাতিচ্যুত করে না। বরং বিনয়ভাষণের মোহ ত্যাগ করা যেহেতু কোনো কোনো স্থানে বাঞ্ছনীয়, অতএব বলাই শ্রেয় যে, ওই সংযোগের মধ্যে মহৎ আর্টের সম্ভাবনা বিদ্যমান। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
সূত্র :আনোয়ার পাশা রচনাবলি তৃতীয় খণ্ড (বাংলা একাডেমি, ১৯৮৭)
লেখক : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ