বিনোদন পাতায় নারীর দাপট

Binoওয়ারিদ ফাতেমী চৌধুরী: গত বছরের প্রথম দিকে ব্রিটিশ অভিনেত্রী মাইলাম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার শুভেচ্ছাদূত হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। এদেশের একটি বস্তিতে যান তাদের জীবনযাত্রা দেখতে।
সেখানে গিয়ে তার বয়সী এক মায়ের কোল থেকে তার শিশুকে কোলে তুলে নেন। এ সময় তাদের কষ্টের কথা শুনে ব্যথিত হয়ে কেঁদেছিলেন মাইলাম। তাদের জীবনযাত্রার মান দেখে ব্যথিত মাইলাম বলেছিলেন, এখানে মানুষ এত কঠিন জীবন যাপন করে আমি ভাবতেই অবাক হয়ে যাই।
মাইলাম ভিজুয়াল জগতের মানুষ। মানুষকে বিনোদন দেয়াই তার কাজ। কিন্তু মানুষের কষ্ট দেখে তার মন কেঁপে উঠে। তার এ আকুলতা তাকে মানবিকতার আসনে বসিয়েছে।
যে জিনিস আমাদের বিনোদিত করে, আনন্দ দেয় তাই বিনোদন। তবে আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোর বিনোদন পাতা দেখলে মনে হয় আমাদের জাতি যেন নারীদের মাঝেই তাদের বিনোদন খুঁজে পায়। মনে হয়, বিনোদনের কেন্দ্রস্থল যেন শুধুই নারী।
দেখা যাচ্ছে, বিনোদন পাতায় নারীদের প্রতাপই বেশি। আমাদের বিনোদন সংবাদকর্মীদের হৃদয়ে বিনোদিনীরা গভীর আসন গেড়ে বসেছেন। তাদের সেই মোহের আয়নার বিম্ব-ই মেলে বিনোদন পাতায়।
দুনিয়ার আদি থেকেই মানুষ কোনো না কোনোভাবে বিনোদন নিচ্ছে। পত্রিকাগুলোও তাদের বাহারি স্লোগানে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কারতে চাচ্ছে।
নজর দেয়া যাক, বাংলা পত্রিকার জগতে সেরার দাবিদারদের দিকে, তারা কি রকম সেরা বিনোদন আমাদের দেয় তাদের মুদ্রিত পাতায়। আসি কোটি পাঠকের পত্রিকা প্রথম আলোর কথায়। একটি সংখ্যা ঘেঁটে দেখা যায়, তাদের রঙ্গলিলার পাতায় সাতটি প্রতিবেদন দিয়ে পাঠককে বিনোদনের খোঁজ দেবার চেষ্টা করেছেন।
তাদের দাবি, দুনিয়া বিখ্যাত তাদের বাংলা পত্রিকা। তাদের এই জগদ্বিখ্যাত বাংলা পত্রিকাটিতে রয়েছে- স্বাগতার প্রেমের হ্যাট্রিক, সোফিয়া লরেনের আবার ফেরা। রানি মুখার্জি চিকন হবেন। ফেসবুকে রমরমা জনপ্রিয়তায় সামিয়া। বৃহন্নলাতে অভিনয় করবেন সোহানা। জেলো এন্টনির নতুন জুটি নিয়ে। আর এক কোনায় আধা ইঞ্চির একটি ছবিতে হাসিয়ে রেখেছেন ইন্ডিয়ার কিং খান শাহরুখকে।
খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাটি না পড়লে ইনি যে শাহরুখ কারো বুঝারই উপায় থাকবে না।
প্রচার সংখ্যার আরেক দাবিদার পত্রিকার সাতটি প্রতিবেদনের কথায় আসি। একই দিন এখানে ছিল চিত্রনায়িকা পূর্নিমা নাকি আবার নতুন করে পথ চলবেন চলচ্চিত্রের পথে। তিনি কোথায় কিভাবে তার পথে চলবেন এই ধারণাই দিতে চেয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের পত্রিকাটি।
তারপর আছে জিনিয়ার ইচ্ছে। তিনি কোন ধরনের নাটকে অভিনয় করতে চান। লাক্স তারকা অপি করিমকে এখন থেকে চিত্রনায়িকা বলতে হবে এমন একটি বিনোদন প্রতিবেদনও রয়েছে।
সেদিন সমকাল ছেপেছে এগারোটি বিনোদন প্রতিবেদন যেখানে প্রথমটিতে আমরা বিনোদিত হবো রানি মুখার্জি ওজন কমাবেন এই সংবাদ শুনে। শাহরুখের ছেলের নামের রহস্য জানিয়েছে আমাদের। আছে তাজিন মিতা নূর একসাথে একটি রিপোর্ট। শেষ রিপোর্টটি ছিলো নাদিয়া নাকি অভিনয় করবেন লাইলি মজনু কাহিনীর লাইলি চরিত্রে।
যুগান্তর স্বাগতাকে নিয়ে লিখেছে- তিনি তিনটি নাটকে পরপর অভিনয় করে হ্যাট্রিক করেছেন। সোফিয়া লরেনের চমকের সাথে রয়েছে অনন্ত-বর্ষার বাজার খাওয়ার সংবাদ। সামিয়া এখন ফেসবুক তারকা, তার ফেসবুক ভক্ত এখন বিশ হাজার।
আমাদের অনলাইন পত্রিকারা তো আরো সরস। একদম সবাইকে ছাড়িয়ে। বিডিনিউজের ১৪টি প্রতিবেদনের মধ্যে এগারটিতেই আমাদের বিনোদন দিতে চেয়েছেন মহিলার মাধ্যমে। এখানে ভারতের বিতর্কিত মহিলা পুনম পান্ডে কোনোভাবেই নিজকে সানি লিওনের সাথে তুলনা করতে চান না। এর সাথে লেখা হয়, সানির মতো তিনি এতটা বেপোরোয়া হতে পারবেন না। অর্থাৎ তিনি সানি লিওনের তুলনায় সাধু।
বিডিনিউজের বিনোদন পাতায় একটি মৃত্যু সংবাদও আছে। মৃত্যুও এখন বিনোদনের বিষয়। মনে হয় যেন রুপালি তারকারা মরলেও বিনোদিত হয় মানুষ। তারা কোনোভাবেই অন্যসব পাতার সংবাদ হতে পারবেন না।
বিদেশি গণমাধ্যমের বিনোদন পাতাগুলোতেও দেখা যায় প্রায় একই অবস্থা। ইন্ডিয়া টাইমস রিপোর্ট করে- তারকাদের আয়, কোন ছবি বক্স অফিস হিট হলো, কোনটি বাণিজ্যিকভাবে সুপারডুপার লেভেলে আছে, কার আগামী ছবি কি, ছবির পরিচালক কে, কার মোট ছবি কতটি।
আর ইকোনমিস্ট প্রায় এরকমই রিপোর্ট করে। তাদের এ দিনের রিপোর্টগুলোকে বলা যায় ভিজুয়াল ইকোনমিক্স। নিউইয়র্ক টাইম এদিন আঠারটি খবর প্রকাশ করে আর্ট এন্ড কালচার নামে বিনোদনের পাতায়। সেখানে ষোলটি সংবাদেই নারী নিয়ে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। নিন্ডসে লোহন বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চান, কেট উইন্সলেট একটি চলচ্চিত্র সংগ্রহাগার করবেন- এই সংবাদসহ আরো বেশ কিছু বিনোদন সংবাদ। তবে সেখানে তারকাদের ঢং পছন্দ আর ব্যক্তিগত আশার কথা তেমন আলোচিত হয়নি।
তবে বিদেশি পত্রিকাগুলোর সাথে আমাদের ব্যবধান অনেক। আমাদের এখানে অভিনয়, গান আর নাচে ভরা থাকে পাতাগুলো।
কিন্তু ওদের পাতাগুলোতে নারীদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের মানবিক কাজের কথাও স্থান পায়। কোনো শিল্পী দুঃস্থদের জন্য কী সাহায্য দিচ্ছেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য কী উদ্যোগ নিচ্ছেন এসব প্রতিবেদন পাওয়া যায় সেখানে।
তারা বোঝাতে চান সবার আগে তারা মানুষ। কিন্তু আমাদের শিল্পীরা কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে আমাদের সামনে আসেন।
অবশ্য আমাদের শিল্পীদের দুঃস্থ বা দরিদ্রদের জন্য মানবিক কাজ করতেই দেখা যায় না। তারা যদি মানবিক কাজ না করেন তবে সাংবাদিকরাই বা লিখবে কোথা থেকে? তারা তো আর সংবাদ বানাতে পারেন না।
ভিজুয়াল তারকারা বিনোদন পাতার গন্ডি পেরিয়ে মূল পাতায় আসতে পারেন না। অথচ আমরা তা চাই। তারা মানবিক তাগিদে এগিয়ে আসবেন, সামাজিক প্রয়োজনে ভূমিকা রাখবেন এটাই প্রত্যাশা করি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button