মার্কিনী সত্তায় কলঙ্ক ও পাশ্চাত্যের লজ্জা
সন্দেহভাজন আরব বন্দিদের ওপর সিআইএ’র পাশবিক নির্যাতনের মার্কিন সিনেটের রিপোর্টে মার্কিনীদের হৃদয়হীন বর্বরতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, দুনিয়ার বিবেকসম্পন্ন মানুষমাত্রই তাতে আতঙ্কিত না হয়ে পারেননি। বৃটিশ সংবাদপত্রে মার্কিনী সত্তায় কলঙ্ক ও পাশ্চাত্যের লজ্জা বলে একে বর্ণনা করা হয়েছে। দুনিয়ার সব সংবাদ মাধ্যম মার্কিনীদের এই বর্বর পরিচয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তাদের কিছু সংবাদপত্রে বন্দি নিপীড়নে মার্কিনী এই ভূমিকাকে মার্কিন জাতীয় চরিত্রের বৈরী ও মূল্যবোধের অবমাননা আখ্যা দেয়া হয়েছে। কোরিয়ান ও ভিয়েতনামীরা যেমন, আরবরাও এতদিনে সম্যক জেনে গেছেন, জাতীয় মূল্যবোধের সাফাই মার্কিনীরা যতই গেয়ে শোনান না কেন, তাদের জাতীয় অস্তিত্বের শুরুই তারা করেছেন নির্বিচার নির্দোষ নরহত্যার মধ্য দিয়ে। মার্কিনীদের রাষ্ট্রীয় যাত্রাই শুরু হয়েছে ভূখন্ডের আদিবাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যাকন্ডের মধ্য দিয়ে। মার্কিন সিনেটের রিপোর্টের বিলম্বিত প্রকাশে আরবদের বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্য নরসংহারের বন্য বর্বরতায় শুরু থেকেই সিদ্ধহস্ত। হত্যা বর্বরতা সংঘটনে শুধু নিজেদের পারদর্শিতা প্রতিষ্ঠাতেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি। অন্যান্য দেশের নিষ্ঠুর একনায়কদের বর্বরতা সংঘটনের দীক্ষাও তারা দিয়ে এসেছে ১৯৭০’র দশক থেকে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে শুধু নিজেরা আরবদের ওপর অমানবিক নিপীড়ন চালিয়েই মার্কিনীরা ক্ষান্ত থেকেছে তা নয়, ক্ষমতালিপ্সু মার্কিন আজ্ঞাদাস আরব একনায়কদের দিয়েও আরব জীবনে অত্যাচারের লহর বইয়ে দিয়েছে এবং একইসঙ্গে তথাকথিত উচ্চাঙ্গের মার্কিন মূল্যবোধের উচ্চকণ্ঠ প্রচার ও বিশ্বজুড়ে মার্কিনীরা চালিয়ে গেছে ভ্লামির সব সীমা অতিক্রম করে। আবু গরির থেকে শুরু করে গুয়ান্তনামোবে হয়ে সন্দেহভাজন আরবদের বন্দি বানিয়ে অন্যান্য আজ্ঞাবহ দেশে নিপীড়নের জন্য পাঠানোর যাবতীয় অপরাধ কর্ম সংঘটনের অকাতরে অন্যায় ভূমিকা এ যাবত মার্কিনীরা নিয়ে এসেছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ যুদ্ধের নামে। ইউকে ‘এজহিল ইউনিভার্সিটি’তে সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ বিজওয়ান সচিব যথার্থই বলেছেন, বন্দি নিপীড়ন হচ্ছে সন্ত্রাসরেই নামান্তর। সন্ত্রস দমনের ঘোষণা দিয়ে মার্কিনীরা নিজেরাই সন্ত্রাসীর ভূমিকায় নেমেছে। অনেকেই বলতে দ্বিধা করেন না, জাতীয় মূল্যবোধের জয়গান মার্কিনীদের মুখে ভন্ডামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। নিপীড়ন হচ্ছে নির্ভেজাল অপরাধ। গুয়ান্তানামোয় সাবেক বৃটিশ বন্দি মোয়াজ্জেম বোপ বিবিসিকে বলেন, মিথ্যা অজুহাতে নির্দোষ মানুষকে বন্দি বানিয়ে নির্যাতনের জন্য অন্য দেশে হস্তান্তর করাও হচ্ছে অপরাধ। মার্কিনীদের ছাড়া অন্য কোনো দেশের মানুষ এমন কর্মে জড়িত পাওয়া গেলে পূর্ণ আইন প্রয়োগে তাদের বিচারের দাবিতে ঐ মার্কিনীরাই মুখর হয়ে উঠত। অথচ অভিন্ন অপরাধে অপরাধী নিজেদের লোকদের মার্কিনীরা বেকসুর খালাস করে দিচ্ছে। বিচারের এই দ্বৈত মানদ- অবলম্বন একমাত্র মার্কিনীদের পক্ষেই সম্ভব। ন্যায়বিচারের ন্যূনতম মানদন্ডেও বন্দি নিপীড়ন আইনসঙ্গত হতে পারে না। এই অন্যায় ও অপরাধ সংঘটনকারীদের তাদের দুষ্কর্মের প্রত্যাঘাতের জন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এর দ্বারা সন্ত্রাস প্রতিরোধ কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না, চলমান বিশ্ব নিত্য তার প্রমাণ তুলে ধরে যাচ্ছে। বহু বছর ধরে বিবেকবান বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, নিপীড়ন সন্ত্রাস প্রয়োগে সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব নয়; বরং এর ফলে সন্ত্রাসের আরো বহুগুণ প্রতিহিংসায় এবং আরো সম্প্রসারিত ক্ষেত্রে মোকাবিলার জন্য মার্কিনীদের প্রস্তুত হতে হবে। তথাকথিত মূল্যবোধের বিচারে নিজেদের ও অন্যদের পৃথক করে দেখানোর মার্কিন ভন্ডামির মুখোশ এতদিনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়ে গেছে। ৯/১১’র চর্বিত বর্ষণে এখন আর ফল মিলবে না। দুনিয়া জেনে গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে বিশেষ শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী ও বিশ্বের সব সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকক। আল জাজিরা অবলম্বনে সৈয়দ আহমদ হোসেন।