মিয়ানমারের উদ্বাস্তুশিবিরে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্বইয়ের কাছে দা পাইং আশ্রয় শিবিরের মাঝখানের নোংরা গলিতে একাকার হয়ে আছে কৃশকায় মুরগি ও ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের সাথে শীর্ণকায় শিশুরা ও কান্ত বয়স্করা।
কারো পায়ে জুতো নেই। পাশেই রয়েছে সারিবদ্ধ ডজনখানেক দীর্ঘ ঘর। এখানে জানালাহীন ঘরগুলোতে বাস করে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার।
বঙ্গোপসাগর থেকে বয়ে আসা লোনা হাওয়া প্রখর রোদে একটু স্বস্তি দেয়। তবুও তাদের শরীর থেকে কেবল হতাশার ঘামই ঝরে। আশ্রয় শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ৫২ বছর বয়সী বা সেইন আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, এখানে সবকিছু ঠিকঠাক নেই।
উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারের সিত্বইয়ের বাইরে দা পাইং প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমের আশ্রয় শিবির। এটি অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তুদের কয়েকটি সমস্যা জর্জরিত আশ্রয় শিবিরের একটি। শিবির থেকে নিঃসারিত হয় হতাশা ও দুর্দশার বায়ু। কেননা মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে এখানকার তালিকাহীন বাসিন্দারা বাড়তি ঝামেলা। ২০১২ সালে এক বছর ধরে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সহিংসতার পর রোহিঙ্গাদের এখানে স্থানান্তর করা হয়। বৌদ্ধদের ওই সহিংসতায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং উদ্বাস্তু হয় কয়েক লাখ। বা সেইন দুঃখের সাথে বললেন, আমরা এখানে দুই বছরের বেশি বসবাস করছি। সরকার এসব শিবিরে আমাদের স্থায়ীভাবে বসতির পরিকল্পনা করছে।
রাখাইনজুড়ে এসব শিবিরে আনুমানিক এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। বেশির ভাগ আশ্রয় শিবিরে খাবার, পানি ও ওষুধের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোরও দারুণ অভাব। আর কাজের সুযোগ বাস্তবেই নেই। রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের শিবির ত্যাগ করতে দেয় না। মিয়ানমার সরকার দাবি করে, রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী। অথচ বাস্তবতা এই যে, অনেক রোহিঙ্গা পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে।
ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে অনেক রোহিঙ্গা এসব শিবির থেকে পালিয়ে গিয়ে কষ্টসাধ্য নৌকাভ্রমণ করে থাইল্যান্ড ও মুসলিমপ্রধান দেশ মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দেন। মালয়েশিয়া তাদের বিনা বাক্যব্যয়ে আশ্রয় দেয়। অনেকে মানব পাচারকারীদের শিকার হয় এবং মিয়ানমার থেকে আসার খরচ পরিশোধের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমার দেশটি ২০১১ সালে নামমাত্র বেসামরিক সরকার প্রবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও এখনো প্রধানত সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
দেশত্যাগ পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত সংস্থা আরকান প্রজেক্ট পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী শুধু গত মাসেই প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়েছে। রাখাইন স্টেট অ্যাকশন প্লান নামে সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া সরকারি উদ্যোগ অনুযায়ী রোহিঙ্গারা নিজেদের বাঙালি হিসেবে নিবন্ধন করলেই নাগরিকত্ব পাবে। বাঙালি শব্দটি ইঙ্গিত করে, তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। যারা এতে সম্মত নয়, তাদের আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে।
এই পরিকল্পনা প্রকাশের পর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার কমিটি রোহিঙ্গাদের সমতার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব দিতে ও বিতর্কিত উদ্যোগ পরিত্যাগ করতে নেইপিডো সরকারকে আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে। রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের একটি বলে সাব্যস্ত করে জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবেই স্বীকার করতে চায় না এবং জাতিসঙ্ঘের আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না। আলু সমুচার তেলমাখা প্লেট ও মিষ্টি চায়ের কাপের চারপাশে মাছি উড়ছে খোলা এই ক্যাফেতে। এখানে বসে বা সেইন স্মরণ করছিলেন ২০১২ সালের সেই সহিংসতার কথা, যা তার লোকদের উদ্বাস্তু করেছে।
তিনি বলেন, ৮ জুন বিকেল ৪টার দিকে অনেক রাখাইন আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে এবং আমাদের হুমকি দিয়ে বলে, আমরা এই দেশের নাগরিক নই। সুতরাং আমাদের এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। সেদিন তারা চলে যায়। কিন্তু পরের দিন সকালে আবার এসে তারা গ্রামে আগুন লাগাতে শুরু করে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ তাদের না থামিয়ে বরং রোহিঙ্গাদের বাধা দেয় তাদের প্রতিহত করা থেকে।
বা সেইন বলেন, গ্রামবাসীরা একটি মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ দিকে তাদের বাড়িঘর লুটপাট করা হয় ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এক রোহিঙ্গা এতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে নিরাপত্তা বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিন দিন পর আটটি সামরিক ট্রাকে এই বিধ্বস্ত গ্রামবাসীকে ভরে আশ্রয় শিবিরে আনা হয়। তখন থেকে তারা এখানেই আছে। একই রকমের কাহিনী বর্ণনা করেছেন রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হওয়া অনেকেই আশা ছাড়েনি। ৪৮ বছর বয়সী আহমদ সাফফার বলেন, রাখাইন জনগণকে ক্ষমা করে দিতে ও তাদের সাথে একত্রে বসবাস করতে আমাদের সমস্যা নেই। ম সন নাইওয়া শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আহমদ সাফফার। এটিও সিত্বইয়ের বাইরে। তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন অন্যান্য সদস্য তার চারপাশে বসা ছিলেন। ২০১২ সালের আগে তারা ছিলেন ব্যবসায়ী, কারবারি এমনকি সরকারি চাকুরে। কিন্তু এখন তারা চাপিয়ে দেয়া দারিদ্র্যে বন্দী। আহমদ সাফফার বলেন, রাখাইনের বৌদ্ধদের সাথে শান্তি স্থাপন সম্ভব। তবে আমাদের প্রয়োজন সরকারি সহায়তা। -সূত্র-আনাদোলু এজেন্সি