ওয়াজ মাহফিল : হিদায়াতের উৎস হোক

এহসান বিন মুজাহির: ওয়াজের মওসুম শুরু হয়েছে। মানুষের ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধি ও আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধনের ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াজ যেহেতু একটি দ্বীনি বিষয়, তাই দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও আমাদের রাসূল সা:, সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহিনের অনুকরণ করা চাই।
কিভাবে তারা ওয়াজ করতেন, তাদের ওয়াজে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পেত, কেন তারা ওয়াজ করতেন, ওয়াজে তাদের অঙ্গভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর কেমন হতো- এসব বিষয় সম্পর্কে জেনেবুঝে এবং তা মেনে যদি ওয়াজ হয়, তাহলে সেই ওয়াজই শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজ বলে পরিগণিত হবে। এর দ্বারা সমাজের মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে।
ওয়াজ মাহফিল নতুন কোনো বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে তা নিজস্ব গতি ও নিয়মে চলে আসছে। তবে ইদানীং নিয়ম-নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন পরিলতি হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান যুগের ওয়াজ মাহফিল, সভা-সম্মেলনগুলো নিছক একটি প্রথা ও বার্ষিক অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সেকালের মাহফিলগুলো সাধারণত মাদরাসাকেন্দ্রিক অনুুষ্ঠিত হতো। যেখানে মাদরাসা ছিল না, সেখানে এলাকার ধর্মপ্রাণ লোকের উদ্যোগে এ ধরনের মাহফিলের আয়োজন করা হতো। একালে শুধু মাদরাসা নয়, প্রতিটি গ্রামগঞ্জ, পাড়ামহল্লা ও প্রতিটি রোডে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন. যুব সঙ্ঘ, সংস্থা, পরিষদ ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ বিশেষভাবে লণীয়। সেকালে মাদরাসার মাহফিল জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্র্ত আর্থিক সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হতো। কোনো কোনো দ্বীনি মাদরাসার মাহফিল কয়েক দিনব্যাপী থাকত। কোনো কোনো এলাকায় টানা কয়েক দিন তাফসির মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কুরআন-হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করতেন। মুসলমানদের ইমান-আকাইদ ও আমলি সংশোধন. আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করতেন। তৎকালীন ওলামা ও বুজুর্গানে দ্বীনদের কাছে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের কোনো ঘাটতি ছিল না। বর্তমানে সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি-উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলোর ইতিবাচক ফায়দা কিন্তু একেবারে কম নয়।
মদ, জুয়া,যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে রেওয়াজ ও লোকদেখানোর উদ্দেশে না হয়, সেদিকে অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের েেত্রও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়া ওলামা ও বুজুর্গানে কেরামগণকে মাহফিলে দাওয়াতের েেত্র অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুই ওই আমল কবুল করেন, যা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য করা হয় (বাইহাকি শরিফ)।
হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদতসমূহকে কবুল করবেন না’ ( মিশকাত : ৪১০)।
ইমাম গাজ্জালি রাহ: তার লিখিত ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন,ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া থেকে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহব্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রে“াতাদেরকে পরকালমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার দীা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানেরা যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে (মাজালিসুল আবরার : ৪৮২)।
বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক ; সেগুলো হলো- ১. ইলম। কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অম।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য।
৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা।
৪.বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলবেন।
৫. বক্তার ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)
ওয়াজকারী ব্যক্তির জন্য দু’টি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি তা না থাকে তাহলে মানুষের হিদায়াত হবে না। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,‘তোমরা তাদেরকে অনুসরণ করো যারা দ্বীনি বিষয়ে কোনো পারিশ্রমিক চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’ (সূরা ইয়াসিন :২১)।
ওয়াজকারীর দুই গুণের প্রথমটি হলো : সে অপরকে যে পথের উপদেশ দেবে, সে নিজে সেই পথে চলবে। অর্থাৎ অপরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার আগে প্রথমে নিজে দ্বীনের পথে চলা।
দ্বিতীয় গুণ, ওয়াজ করবে নিঃস্বার্থভাবে। অর্থাৎ দাওয়াত দেবে মানুষকে কোনো বিনিময় ব্যতীত।
তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনে আল্লামা মুফতি শফী র: লিখেছেন, ‘দুই শ্রেণীর বক্তার বক্তৃতায় মানুষের কোনো হিদায়াত হয় না। ১.একশ্রেণী যারা মানুষকে আমলের কথা বলে, ভালো পথে চলার কথা বলে আর নিজেই এর আমল করে না। ২. আরেক শ্রেণী হলো, যারা ওয়াজ করে মানুষের কাছে টাকা চায়। এই দুই প্রকার বক্তার বক্তব্যে মানুষের হিদায়াত ও কোনো উপকার হবে না।
যে ওয়াজের মূল উদ্দেশ্য হয় লোকদেখানো ও প্রসিদ্ধি লাভ, সে ওয়াজ যতই চমকপ্রদ হোক না কেন, মানুষ এর থেকে কোনো হেদায়াত পাবে না। যুগ যুগ ধরে জাতির রাহবার ওলামায়ে কেরাম উম্মতের হিদায়াতের ল্েয দ্বীনের অন্যান্য খিদমতের পাশাপাশি একনিষ্ঠতার সাথে ওয়াজ মাহফিলের কাজ চালিয়ে গেছেন। খেয়ে না খেয়ে, দেশ দেশান্তরে সফর করে দ্বীন প্রচার করেছেন হজরত ওলামায়ে কেরামগণ। তথ্যনির্ভর ইখলাস ও নিষ্ঠাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে কুরআন-হাদিসের কথাগুলো পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। আওয়াম মানুষও তাদের বয়ান শুনে ইতিবাচকগুলো গ্রহণ ও নেতিবাচকগুলো বর্জন করে খুঁজে নিয়েছেন ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ।
বর্তমান জামানায় দাওয়াতি কার্যক্রম (ওয়াজ মাহফিল) বহুগুণে বেড়েছে। মাদরাসা ও মসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন সঙ্ঘ কর্তৃক অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা-সম্মেলন। এগুলো খুব মহৎ উদ্যোগ। যারা এগুলোর আয়োজন করেছেন আল্লাহর দরবারে সহিহ নিয়তের কারণে অবশ্যই এর প্রতিদান পাবেন, পুণ্যের অধিকারী হবেন।
শেষ কথা : ইখলাস ও নিষ্ঠাবিহীন ওয়াজ কখনো কারো উপকারে আসে না। স্বার্থবাদী (কনটাক্টওয়ালা, ইখলাস ও ইলমহীন আলেম) বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালে ওয়াজে কারো হিদায়াত আসবে না। ওয়াজে ইখলাস ও নিষ্ঠা জরুরি। ওয়াজ দ্বারা মানুষ ও সমাজকে পাল্টাতে হলে সর্বাগ্রে সবার নিয়ত পরিশুদ্ধ করা দরকার। –লেখক : প্রবন্ধকার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button