হারানো গৌরব পুনরুজ্জীবনের পথে তুরস্ক

Erduganতুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান নিজের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করেছেন। তার এ পদক্ষেপের ব্যাপারে পশ্চিমা জগতের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রতীকী প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এ বছর তুরস্ক জি-টোয়েন্টির সভাপতির পদ গ্রহণ করেছে এবং ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব কারণে দেশটির একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে।
দেশ-বিদেশের সমালোচকেরা ক্রমবর্ধমানভাবে এরদোগানকে একজন অচিন্তনীয় নেতা হিসেবে মনে করছেন। তিনি অধিকতর শক্তিশালী প্রেসিডেন্টের পদ ও রাজনৈতিক বৈরীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতি বিশেষ নজর দিচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা এরদোগান তুরস্ককে আইনের শাসন ও বাক-স্বাধীনতার পশ্চিমা মানদণ্ড থেকে তুরস্ককে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে তার সমর্থকেরা দেশটিতে ৯০ বছরের সেকুলার বা ধর্মবিরোধী অভিজাত শ্রেণীর শাসনের পর তাকে তুরস্কের হারানো গৌরব ও উসমানি খেলাফতের আমলের ইসলামি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের অগ্রসেনানী বলে গণ্য করছেন। তারা তার বিভিন্ন নতুন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বড় বড় উন্নয়নশীল ও অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলো নিয়ে গঠিত জি- টোয়েন্টির পালাক্রমিক প্রেসিডেন্টের পদ ১ ডিসেম্বর থেকে গ্রহণ করেছে তুরস্ক। তুরস্ক একে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর দাবিকে জোরদারভাবে তুলে ধরা এবং বাণিজ্য ও কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার কাজে ব্যবহার করতে চায়।
সম্প্রতি এরদোগানের সাথে সাক্ষাৎকারী নেতাদের তালিকা থেকেই তুরস্কের গুরুত্বের বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। তাদের মধ্যে ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, পোপ, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ক্যাথেরিন এস্টোন। জ্বালানি  নিরাপত্তা এবং প্রতিবেশী ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ তুরস্কের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। হ্যান্ডশেক ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির আড়ালে তুরস্কের স্বাধীনতার রেকর্ড দৃশ্যত কমে যাচ্ছে।
এক সপ্তাহ আগে পুলিশ এরদোগানের রাজনৈতিক বৈরির প্রচারমাধ্যমের দফতরে পুলিশ অভিযান চালায় এবং গত বছর সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ফুটবল সমর্থকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
লন্ডনের থিংকট্যাংক কাথাম হাউজের তুরস্কবিষয়ক বিশ্লেষক ফাদি হাকুরা বলেন, ‘তুরস্কের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তার মিত্ররা আংকারাকে সবসময়ই কিছুটা ছাড় দিয়ে আসছে….প্রেসিডেন্ট এরদোগান যে নীতিই অনুসরণ করুন না কেন, তারা তুর্কি জনগণকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না।’
সংবাদপত্রের দফতরে পুলিশের অভিযানের ব্যাপারে ব্রাসেলসের সমালোচনার জবাবে এরদোগান ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিজের চরকায় তেল দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তার শত্রুদের ‘নোংরা তৎপরতা’ পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এ ধরনের অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছিল। এর সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনো যোগসূত্র নেই। উল্লেখ্য, তুরস্ক নিজেই ইইউর সদস্যপদ লাভের জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করছে।
তুরস্কের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি ইইউ সূত্র জানায়, আগামী বছর জুনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে এক নায়কতান্ত্রিক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে সূত্র এ কথা স্বীকার করেছে যে, সিরিয়া থেকে সাইপ্রাস সঙ্কটকের বিষয়ে ইইউর হাত গুটিয়ে বসে না থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার।
উসমানি খেলাফতের স্পর্শকাতর দিক
এরদোগানের সমালোচকেরা বলছেন, ইসলামি আদর্শের আলোকে একে পার্টি গঠন এবং মাত্র এক দশক আগে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সব ধরনের ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সেকুলারপন্থী সেনাবাহিনীকে বেসামরিক সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। ১৯৬০ সাল থেকে সেনাবাহিনী চারটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এ ছাড়া আদালত থেকে পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যম থেকে স্কুল ও কলেজের ওপরও তিনি তার আদর্শিক ছত্রছায়া বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানের অধ্যাপক জেনি হুয়াইট বলেন, ‘উসমানি আমলের সুন্নি ভ্রাতিত্বের রোমাঞ্চকর মতাদর্শই’ এরদোগানের একে পার্টি বার্তায় পরিণত হয়েছে। তিনি চলতি মাসে সাময়িকী কারেন্ট হিস্টোরিতে লিখেছেন, ‘এরদোগান (নিজেকে) জাতীয় সম্মানের রক্ষক হিসেবে মনে করছেন এবং উদারবাদের বিপজ্জনক বিতর্ককে কোণঠাসা করে রেখেছেন।
সমালোচকেরা বলছেন, তার গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারণা হলো ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে তাকে পরাজিত করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে তিনি তাকে ভোটপ্রদানকারী ৫২ শতাংশের স্বার্থে দেশ শাসন করছেন যাতে বাকিরা উপেক্ষিত হচ্ছেন।
স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার আরো বিস্তার ও উসমানি আমলের তুরস্কোর শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করাকে তার সমালোচকদের অনেকে আধুনিক তুরস্কের পরিচিতিতে ঐক্য চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা বলে দেখছেন। এরদোগানের সমর্থকেরা বলেন, তিনি ১৯২০ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের চাপিয়ে দেয়া সেকুলার বা ধর্মহীন শাসনের সময় ধ্বংস করা ঐতিহ্যের সাথে দেশের সম্পর্ককে নতুনভাবে সংযোজিত করার জন্য দেশের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্সাকেই তিনি বাস্তবে রূপায়িত করছেন। -রয়টার্স

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button