যুদ্ধপ্রবণতা কি মানুষের স্বভাবজাত?
সারফুদ্দিন আহমেদ
সামাজিক জীববিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণাক্ষেত্রের পথিকৃত্ এডওয়ার্ড উইলসন তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, ‘যুদ্ধ আমাদের স্বভাব ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে প্রোথিত।’ এই বিশ্বাস যে কেবলমাত্র সামাজিক জীববিজ্ঞানীদের মধ্যেই রয়েছে তা নয়, নৃতত্ত্ববিজ্ঞান ও মনুষ্য আচরণবিষয়ক অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষকেরাও একই ধারণা পোষণ করে আসছেন।
আধুনিক মানুষের প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেখে তাঁরা যে এই ধারণা পেয়েছেন, বিষয়টি সে রকম নয়। কৃষিকাজ শেখার আগে আদিম মানুষ শুধু শিকার করে বেঁচে থাকত। ‘হান্টার গ্যাদারার’ হিসেবে পরিচিত এ ধরনের কিছু মানুষ এখনো টিকে আছে। এরা এখনো আগের মতো তির-ধনুক, বর্শা ইত্যাদি দিয়ে শিকার করে জীবন চালায়।
গবেষকেরা মানুষের যুদ্ধপ্রবণতা-বিষয়ক ধারণায় পৌঁছতে এসব হান্টার গ্যাদারারের জীবনাচরণও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের ‘ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি’ শিম্পাঞ্জিদের উন্মত্ত আচরণের নিবিড় পর্যবেক্ষণ।
এসবের মধ্য দিয়ে গবেষকেরা এত দিনে আপাতগ্রাহ্য এই যুক্তিতে উপনীত হয়েছেন, মানুষ তার বংশগতি নির্ণায়ক জিনের মধ্যেই যুদ্ধপ্রবণতা বহন করে আসছে। অর্থাত্ স্বভাবগতভাবেই মানুষ যুদ্ধপ্রবণ।
নিজ স্বজন, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে অন্যদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য যুগ যুগ ধরে নিজের জীবন উত্সর্গ করার যে প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে, জিনের মধ্যে যুদ্ধপ্রবণতা থাকার ধারণাকে এ বিষয়টি আরও জোরালো করে তুলেছে।
তবে ফিনল্যান্ডের আবো অ্যাকাডেমি ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক ডগলাস ফ্রাই ও প্যাট্রিক সোডারবার্গ ‘সায়েন্স’ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে লেখা এক প্রতিবেদনে স্বভাব ও জিনগতভাবে মানুষ যুদ্ধপ্রবণ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ডগলাস ফ্রাই ও প্যাট্রিক সোডারবার্গ আধুনিক হান্টার গ্যাদারারদের অজানা বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ কথা ঠিক, একুশ শতকের এই সময়েও আদিম জীবনযাপনে অভ্যস্ত যেসব হান্টার গ্যাদারার রয়েছে, তাদের অবস্থান শান্তশিষ্ট জীবনযাপন থেকে অনেক দূরে; তবে এটাও ঠিক যে তাদের অবস্থান সার্বক্ষণিক যুদ্ধবিগ্রহ থেকেও অনেক দূরে। তাদের মধ্যে সহিংসতায় যারা নিহত হয়, তাদের বেশির ভাগই মারা যায় নিজেদের মধ্যে মারামারি করে; ‘বিদেশি’দের হাতে নয়। তাদের মধ্যে যারা খুনি, তাদের মধ্যেও যথেষ্ট মানবিক দিক লক্ষ করা যায়।
ড. ডগলাস ফ্রাই ও প্যাট্রিক সোডারবার্গ সারা বিশ্বের মোট ২১টি হান্টার গ্যাদারার গোষ্ঠীর ওপর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। ১০০ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে এই মানবগোষ্ঠী নিয়ে যত এথনোগ্রাফিক স্টাডিজ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন তাঁরা। এসব গবেষণায় হান্টার গ্যাদারারদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের বিশদ তথ্য উঠে এসেছে।
এই দুই গবেষক ওই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘর্ষজনিত হত্যা, পরিবারে পরিবারে সংঘর্ষজনিত হত্যা, গোত্রের সমন্বিত সিদ্ধান্তে দেওয়া শাস্তিস্বরূপ মৃত্যু ও গোত্রে গোত্রে সংঘর্ষ। শেষোক্ত সংঘর্ষকেই ‘যুদ্ধ’ বলে ধরা হয়েছে।
যে ২১টি হান্টার গ্যাদারার গোষ্ঠীর ওপর গবেষণা করা হয়েছে, দেখা গেছে তাদের মধ্যে তিউয়ি (অস্ট্রেলিয়ার একটি আদিবাসী সম্প্রদায়) নামের একটি গোষ্ঠী প্রচণ্ড মাত্রায় যুদ্ধপ্রবণ। ২১টি গোষ্ঠীর মধ্যে যতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে এই গোষ্ঠীর মধ্যে এবং এসব ঘটনার অর্ধেকই ‘যুদ্ধ’ পর্যায়ের।
তিউয়ি গোষ্ঠীর বাইরের হিসাব ধরলে হান্টার গ্যাদারারদের মধ্যে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ হয়েছে যুদ্ধপরিস্থিতিতে। আর তিউয়িদের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করলে যুদ্ধপরিস্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান এমন ধারণা দেয় না যে হান্টার গ্যাদারারদের মধ্যে প্রতিবেশী গোষ্ঠীর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধবিগ্রহ করে বেড়ানোর প্রবণতা আছে।
অবশ্য নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফি ইনস্টিটিউটের গবেষক স্যামুয়েল বাওয়েলস ২০০৯ সালে যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, তা সাম্প্রতিক এই গবেষণা থেকে ভিন্নমত নির্দেশ করে।
ওই গবেষণায় বাওয়েলস দাবি করেন, হান্টার গ্যাদারার সমাজে লড়াই-সংঘাত এতটাই সাধারণ ঘটনা, যা সহজেই ওই সমাজের মানুষকে লড়াইয়ে আত্মোত্সর্গের জন্য উদ্দীপ্ত করেছে।
যা হোক, তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানসমৃদ্ধ এই আধুনিক সভ্য মানুষের মধ্যে হান্টার গ্যাদারারদের চেয়ে কম, নাকি বেশি যুদ্ধপ্রবণতা—তা সুনির্দিষ্ট করা অসম্ভব। হান্টার গ্যাদারারদের তির-ধনুকের তুলনায় আধুনিক মানুষের মেশিনগান এত বেশি প্রাণঘাতী যে এ ধরনের তুলনা করা অর্থহীন। তবে এ কথা সত্য, সভ্যতার ক্রমবিকাশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনী হওয়ায় এবং প্রকাশ্য অস্ত্র বহন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখায় গত কয়েক শতকে খুনের হার কমেছে।