সুনামির ১০ বছর : আন্দামানে নতুন জীবন
দশ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ভোরে পৌঁছেছিলাম আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর পোর্ট ব্লেয়ারে – কলকাতা থেকে ত্রাণ সামগ্রী বয়ে নিয়ে যাওয়া একটা বিমানে।
প্লেনটা যখন নামছিল, তখন নিচের নীলচে সবুজ সমুদ্র দেখে বোঝার উপায় ছিল না কী ধ্বংসলীলা চলেছে তার চব্বিশ ঘণ্টা আগে।
তার পরের দিনগুলোয় যখন কার নিকোবর, ক্যাম্পবেল বে বা দক্ষিণ আন্দামানের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছি, তখন দেখতে পেয়েছিলাম সেই ধ্বংসের ছবি। কার নিকোবর বা ক্যাম্পবেল বে বিমানঘাঁটি দেখে মনে হয়েছিল শত্রুদেশের বিমান হামলা হয়েছে। বাহিনীর অফিসারদের সপরিবারে বাস করার কোয়ার্টারগুলো যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনও ধ্বংসস্তূপ।
বিমানঘাঁটিগুলোতে লাইন দিয়ে বসেছিলেন হাজার হাজার মানুষ – বয়স্ক, শিশু, মহিলা, পুরুষ – একটানা তিন দিন, চার দিন বা আরও বেশি। অপেক্ষা – কখন বিমানবাহিনীর উদ্ধারকারী প্লেনগুলোতে জায়গা হবে। সবার চোখে মুখে তখনও আতঙ্ক, শরীরে আঘাত, পেটে খিদে আর মনে স্বজন ও ঘর হারানোর কষ্ট। দশ বছর পর গত সপ্তাহে একই জায়গায় গিয়ে দেখতে পেলাম সব হারানো মানুষগুলো কিভাবে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কৃষি জমি হারিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পর্যটকদের চায়ের দোকান করেছেন ওয়ান্ডুর সৈকতের মেঘনাথ দাস। আর চোলদারি গ্রামের নিরত মধু এতদিন শুধুই সবজির চাষ করার পরে এই প্রথম আবারও ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু তপন মণ্ডলের মতো অনেকের জমিতেই আর ভাল চাষ হয় না – ধান তো দূরের কথা। তাই সুনামির আগে কৃষি-শ্রমিকের কাজ করতেন যে আলফঞ্জ মিনজ, তিনি এখন পর্যটকদের গাড়ি চালান। ক্ষতিপূরণ আর স্থায়ী সুনামি আবাসগুলোতে ঘর পেয়েছেন সবাই। কিন্তু সেগুলো জনবসতি থেকে অনেক দূরে – পাহাড়ের ওপরে – ডাক্তার থেকে শুরু করে খাবার – সব কিছুর জন্যই গাড়ি ভাড়া দিয়ে নিচে যেতে হয়।
আর তার ওপরে কর্মসংস্থান হারিয়ে যাঁদের সুনামি আবাসে আসতে হয়েছে, তাঁদের জন্য কোনও কাজের ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সামান্য চাকরি করতে হচ্ছে সুরেশ বা চমন তির্কেদের। আবার বাম্বু-ফ্লাট বছর পাঁচেকের মধ্যেই সেই সব আবাসের কাঠের তক্তাগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে – বর্ষায় জল পড়ে আর সাপখোপের ভয়তো আছেই।
অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ আর স্থায়ী সুনামি আবাস পাওয়ার পর সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা, সেই নিকোবরী আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে যেতে বসেছে।
ক্ষতিপূরণের টাকায় টি ভি, ফ্রিজ বা মোটর সাইকেল কিনে, কোনও কাজ না করে বসে থেকেছেন বেশীরভাগ নিকোবরী।
আর সমুদ্রের ধার থেকে পাহাড়ের মাথায় আবাসগুলো তৈরি হওয়ায় হারিয়েছেন নিজেদের চিরাচরিত বসবাসের জায়গা বা আয়ের উৎস নারকেল বাগানগুলো।
নিকোবরী আদিবাসীদের রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স রশিদ ইউসুফ জানাচ্ছিলেন যে এজন্যই আধুনিক সমাজের বিভিন্ন রোগ-ব্যধি – ব্লাড প্রেশার, সুগার – এসব দেখা যাচ্ছে এখন।
সবাই নিজের নিজের মতো করে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করেছেন গত দশ বছরে।
এমনকি ভি ভাসুদেভও, আড়াই বছরের জ্যোতিপ্রিয়ার বাবা – সুনামির ঢেউ যে শিশুটিকে মা বাবার হাতছাড়া করে দিয়েছিল, বালিতে অনেক খুঁজেও দেহটাও পাননি ভাসুদেভ, তবে এখনও ২৬ ডিসেম্বর সকালে এবং জ্যোতিপ্রিয়ার জন্মদিনে সুনামি স্মারকে যান স্ত্রীকে নিয়ে, যে স্মারকে আড়াই বছরের হারিয়ে যাওয়া জ্যেতিপ্রিয়ার নম্বর ৫৫৭। – অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি বাংলা, কলকাতা