ইসলামিক স্টেটের অভ্যুদয় আকস্মিক নয়

ISISসাদ্দাম জমানায় ইরাকী বাথ পার্টির মতাদর্শ ও কর্মসূচি নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করত নিখিল আরব জাতীয় পরিষদ বা প্যান আরব ন্যাশনাল কমান্ড। এদের এক প্রতিনিধি সাভায় মিসরে ও সুদানে সক্রিয় মুসলিম ব্রাদারহুডের এবং বাথ পার্টির মধ্যকার যাবতীয় বিরোধের অবসান চেয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করেন সাদ্দাম হোসেন। এমনকি ব্রাদারহুডের সঙ্গে মৈত্রী গড়ার প্রস্তাবও করেন তিনি। কথিত ইসলামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টির সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা ইরাকের ইতিহাসে এটিই প্রথম। গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী ও আরব ঐক্যকামী রাষ্ট্রের এবং ব্রাদারহুডের কাম্য ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যও ঐ বছরই তার অন্য এক বক্তৃতায় সাদ্দাম স্পষ্ট বর্ণনা করেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও নিখিল আরব বাথ পার্টির জন্মদাতা মিচেল আফলাফের অনুসরণে সাদ্দাম ঘোষণা করেন তিনি নাস্তিক নন এবং একইসঙ্গে সুন্নি বা শিয়াপন্থী যে কোনো দলকে সঙ্গে নিয়ে কোনো ধর্মীয় দল গড়ার চেষ্টার বিরুদ্ধেও তিনি সতর্ক করে দেন। প্রধানত শিয়া সম্প্রদায়ভিত্তিক ইসলামী দাওয়া পার্টির এক সমাবেশে পরংপরাগত ইসলামী বিচার ব্যবস্থাকেও সাদ্দাম পুরনো এবং অকেজো আখ্যা দেন ও বাতিল ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ইসলামী দাওয়া পার্টি তখন ছিল বাথ পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী।
১৯৯০ দশকে শুরুর পরবর্র্তীতে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হিসেবে আবির্ভূত হন সাদ্দাম। তার এই আগ্রহের অনুকূলে নানা নিবন্ধ ও মন্তব্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইরাকী প্রচারমাধ্যমে বিজয়ী বীর হিসেবে সাদ্দাম তখন চিত্রিত হচ্ছিলেন বিধায় তার সমর্থনে যে কোনো প্রচারণাই সেসময় খুব সহজে পার পেয়ে যেতে পেরেছিল। যদিও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় তখন ইরাক।
১৯৯১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ইরাকে যুদ্ধ প্রচারণা শুরু হয়। পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের বীরযোদ্ধা তখন আখ্যায়িত হন সাদ্দাম। ইরাকী জাতীয় পতাকায় জুড়ে দেয়া হয় ‘আল্লাহ আকবর’। সাদ্দাম ঘোষণা করেন, জেরুসালেমকে তিনি মুক্ত করবেন। কুয়েতে ইরাকী অভিযানের ব্যর্থতা ঐ অভিযানের ফলশ্রুতিতে ইরাকে আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ দেশজুড়ে ইসলামপন্থী প্রচারণার জোয়ার বইয়ে দিয়ে সাদ্দাম তেমন আমলে নেননি দেশবাসীকে বোঝাতে চান। ১৯৯৩-এ পাশ্চাত্য বা তথাকথিত আন্তর্জাতিক অবরোধে ইরাক যখন দুর্দশাগ্রস্ত, ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণা তখন আরো ব্যাপক স্তরে শুরু করেন সাদ্দাম। কিছু রেস্তোরাঁসহ নাইটক্লাবগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এলকোহল নিষিদ্ধ করা হয়। অভিযান চালানো হয় পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের। এই সুযোগে সুন্নি ও শিয়া মতাবলম্বীরা নিজেদের মতাদর্শ প্রচার শুরু করে জোরেশোরে। সাদ্দামকে পূর্ণ সমর্থন জানায় উভয় সম্প্রদায়। ১৯৯৮-এ দেখা যায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ্জত ইব্রাহিম আলদূরীসহ ক্ষমতাসীন পার্টির শীর্ষ কর্মকর্তারা ধর্মীয় সচ্চরিত্রতা ও ঈমানদারী কায়েমে দেশব্যাপী প্রচারণামুখর হয়ে ওঠেন। দেশে মসজিদ তৈরির হিড়িক পড়েছিল ১৯৯৩-এর পর থেকেই। ধর্মভিত্তিক একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হয়েছিল সাদ্দামের নামকরণে ১৯৮৯ সালেই। ইতোমধ্যে বাগদাদ ইউনিভার্সিটির বৌদ্ধিক বলয়ের একাংশে সুন্নি মতবাদের প্রাবল্য প্রকট হয়ে ওঠে। চরম রক্ষণশীল দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করে এদের একটি অংশ। এদের বলা হয় সালাফি। অন্য অংশটি নকশবন্দিয়া তরিকার প্রচারে নামে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য হচ্ছে- উভয় গোষ্ঠী আর্থিক সহযোগিতা ও নৈতিক উৎসাহ পেতে থাকে অভিন্ন উৎস থেকে। নবউদ্যমে এই ধর্মীয় প্রচারণায় অবশেষে আক্রান্ত হয় ইরাকের বিচার বিভাগও। অপরাধের শাস্তি বিধানে অতি পুরনো পন্থা অবলম্বিত হতে থাকে। চুরির শাস্তি বিধাদন হয় অঙ্গছেদের মাধ্যমে।
এককথায় ইসলামী বিধিবিধান অনুসরণে ও ক্রিয়ানুষ্ঠান উদযাপনে ক্ষমতাসীন প্রশাসনের অত্যাগ্রহী পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়েই। ইরাকে পরবর্তীতে আইসিস প্রতিষ্ঠার অঙ্কুর সুন্নি ইরাকীদের মনোভূমিতে প্রোথিত হয়ে যায় মনে করেন অনেকে। আইসিস প্রতিষ্ঠায় ইরাকী সুন্নিদের উৎসাহী মনোভাবে অন্যান্য উপাদানের যোগদানের বিষয়টিকেও এই পর্যবেক্ষকরা অগ্রাহ্য করেন না। তারা উল্লেখ করেন, ইরাকী প্রশাসন ক্ষেত্রে সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে গড়ে ওঠা ভারসাম্যের ধারাবাহিকতা শিয়াদের প্রতি নূরী আল মালিকীর অতি প্রকট পক্ষপাতিত্বে খুব ক্ষিপ্র গতিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, মালিকী শাসনে বিকট শক্তিতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতিও সুন্নি শক্তির আইসিস গঠন চেষ্টায় সহায়ক ভূমিকা নেয়।
উল্লেখ্য, ২০০৩-এর পর থেকে প্রশাসনে সুন্নিদের অর্থবহ অংশগ্রহণে শিয়া অধ্যুষিত সরকারের কেউই কোনো আগ্রহ দেখাননি। আইসিসের আবির্ভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়- প্রশাসনকে বাথ প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে ইরাক প্রশাসনের হৃদয়হীন পদক্ষেপগুলো। ৪০ হাজারের বেশি বাথ সদস্যের অধিকাংশই কর্মচ্যুত হন- ২০০৩ পরবর্তী ইরাকী প্রশাসনে। ইরাকী জনজীবনের এক-তৃতীয়ংশই সুন্নি হওয়ার কারণে অমানবিক দুর্দশার জীবনে নিক্ষিপ্ত হন। এই অধঃপতিত অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তির মঞ্চে আরোহণের স্বাদ সুন্নিরা উপভোগ করেন ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়ে। -আল জাজিরা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button