আফগানিস্তানে ১৩ বছরের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী পেল
শুরু করার ১৩ বছর পর আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এত চড়া মূল্যে সে কি পেল। ২৩০০ মার্কিন সৈন্যের মৃত্যু ও এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয়ে আমেরিকার ইতিহাসে দীর্ঘতম যুদ্ধের শেষে বিজয়ের আনন্দময় অনুভূতির বদলে খেদ ও অবসাদের মাত্রাই বেশি।
মার্কিন কমান্ডাররা জোর দিয়ে বলছেন, তালিবানের সাথে এখন লড়াই চালাবে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী। তবে কিছু কর্মকর্তার আশংকা যে, এক্ষেত্রে ইরাকের ঘটনা ঘটবে। সেখানে জিহাদিদের আক্রমণের সামনে ইরাকি সেনাবাহিনী কার্যত ভেঙে পড়ে।
সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা যায়, আমেরিকার এক বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এখন বলছেন যে, এ লড়াইয়ের প্রয়োজন ছিল না। মার্কিন সৈন্যদের ২৩ শতাংশের বিশ্বাস যে, মিশন সফল হয়েছে। তবে যখন এ যুদ্ধ শুরু হয় তখন এর প্রতি ব্যাপক মাত্রায় সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল এবং মনে করা হয়েছিল যে বিজয় হাতের মুঠোয়।
২০০১ সালে আল কায়েদার হামলার এক মাসেরও কম সময় পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ অক্টোবরে যখন টেলিভিশন বক্তৃতায় আফগানিস্তানে সামরিক ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেন তখন জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্রোধকে ব্যবহার করেন। বুশ তখন বলেন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে আফগানিস্তানের ব্যবহার বন্ধ এবং আল কায়েদার আশ্রয়দাতা ও তাদের নেতাদের হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তালিবান প্রশাসনের উপর হামলাই এ অভিযানের লক্ষ্য।
বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জিত হয়। তালিবান প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো নিশ্চিহ্ন করা হয় এবং মার্কিন বিমান হামলার ছত্রছায়ায় ও অল্প কিছু সংখ্যক মার্কিন বিশেষ বাহিনীর সমর্থনে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের যোদ্ধারা একমাসের মধ্যে তালিবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তালিবান প্রতিবেশী পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে পুনর্গঠিত হয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরে যায় ইরাকের নতুন যুদ্ধে। কাবুলের দুর্নীতিবাজ, কার্যকর সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে তালিবান ভয়ংকর সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র তালিবানের সাথে লড়াইয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন করে যারা তালিবানের সাথে প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী ক্রমশ প্রাধান্য বিস্তার করলেও যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন দূরেই রয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কয়েক দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত দারিদ্র্য কবলিত একটি দেশে দেশগঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মহৎ আদর্শের কথা শুনিয়েছিল।
তবে আশাব্যঞ্জক ফল দেখা যায়নি। রাস্তা ও স্কুল নির্মাণে আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তাতে দুর্নীতিও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায়, আর এ অর্থের কিছু অংশ তালিবানদের কাছেও চলে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তালিবানের সাথে শান্তি আলোচনায় ফল হয়নি। সমালোচকরা বলেন, মার্কিন হামলার প্রথম দিকে তালিবানরা যখন পলায়নপর ছিল তখন তাদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে। দেশি বোমা সজ্জিত ও পাকিস্তানের অভয়াশ্রমের সুবিধাভোগী অধরা তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই পাশ্চাত্যের সৈন্যদের জন্য হতাশাজনক বলে প্রমাণিত হয়। অচেনা পরিবেশে তাদের ভিন্ন ভাষা ও উপজাতীয়দের বৈরিতা মোকাবিলা করতে হয়।
“হোয়াই উই লস্ট” গ্রন্থের লেখক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ড্যানিয়েল বলগার লিখেছেন, কমান্ডাররা আরো সৈন্যের আবেদন জানান। আর ওয়াশিংটন এ ব্যর্থ আশায় সৈন্য পাঠাতে থাকে যে, কোনভাবে কিছু উন্নতি ঘটবে।
সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ১ লাখ সৈন্য পাঠায়। এখন তা ১১ হাজারে নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্যদিকে ন্যাটোর মিশনের ইতি টানা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, মার্কিন অভিযানের ফলাফল মিশ্র। এ অভিযান আল কায়েদাকে অভয়াশ্রম থেকে বঞ্চিত করেছে, তালিবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, নারীদের উপর নিপীড়ন হ্রাস করেছে এবং আফগান সেনাবাহিনী তৈরি করেছে যা তালিবানকে তাদের একদা প্রাধান্যে প্রত্যাবর্তন কঠিন করে দিয়েছে।
তবে মার্কিন কমান্ডোদের হাতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়া সত্ত্বেও আল কায়েদা বিভিন্ন স্থানে তাদের সেল প্রতিষ্ঠা করে এবং সিরিয়া ও ইরাকেও বিস্তার লাভ করে।
তালিবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় না থাকতে পারে, কিন্তু পরাজিত থেকে অনেক দূরে এবং তারা কাবুল সরকারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্রোত ঘুরিয়ে দিতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ভ্যান্ডা বেলবাব-ব্রাউন বলেন, ২০০১ সালে যেমন ছিল এখন তালিবান সে অবস্থায় নেই, কিন্তু অবশ্যই তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি।
মার্কিন কর্মকর্তাদের আশা যে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পিছনে আর বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে না, কিন্তু তালিবানরা ইতিমধ্যে আমেরিকান সৈন্যদের ছেড়ে আসা কিছু এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
দক্ষিণের হেলমান্দ প্রদেশে কূটনীতিক হিসেবে দু’বছর দায়িত্ব পালনকারী ও একটি যুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থের লেখক কার্টার মালকাসিয়ান বলেন, আগামী বছর আফগান সেনাবাহিনীর জন্য বড় পরীক্ষার বছর। যদি তারা হারতে থাকে তার অর্থ হবে এ লড়াই চলতেই থাকবে। আর তা যদি হয়, তালিবান শক্তিশালী হতে থাকবে।