হায়রে জামায়াত! হায়রে শিবির!

Roniগোলাম মাওলা রনি:
জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে আমি কোনো দিনই তেমন একটা ভাবিনি। মাঝে-মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রগতিশীলদের বিরূপ সমালোচনা আমার মনকে তাদের ব্যাপারে বিষিয়ে তুলেছিল। এর বিপরীতে জামায়াতকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নিরন্তর চেষ্টারত রাজনৈতিক দলগুলোর বেহায়াপনা এবং মোনাফেকী আচরণ দেখে যারপরনাই বেদনাহত হতাম। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের পত্তন, বেড়ে ওঠা এবং স্থায়িত্ব লাভের দায় এড়াতে পারবে না কেউ। ‘৭৫-পরবর্তী সব সরকারই তাদের টানাটানি করেছে এবং এখনো যে করছে না সে কথা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলছে না। সার্বিক এ অবস্থায় জামায়াত কী করেছে এবং নিজেদের সতীত্ব হারিয়ে কতটা অপরাধ কিংবা ভুল করেছে তা যদি তারা বিশ্লেষণ না করে তবে আগামী দিনে তাদের অস্তিত্বই থাকবে না।
আমার প্রথমেই মনে হয় জামায়াত তাদের নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারেনি এবং পারছে না। তারা ঘৃণা, জনরোষ, শত্রুতা এবং প্রতিযোগিতার অর্থটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। বাংলাদেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক হিংসা, ক্রোধ, প্রতিযোগিতা এবং শত্রুতা রয়েছে। কিন্তু তারা কেউ কাউকে রাজনৈতিক কারণে ঘৃণা করে না। অন্যদিকে জামায়াতবিরোধীরা জামায়াতকে প্রবলভাবে ঘৃণা করে এবং এদের সংখ্যা দেশের রাজনৈতিক সচেতন লোকদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠী জামায়াতিদের সঙ্গে সামাজিক, পারিবারিক, বৈবাহিক এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক করতে ইচ্ছুক নন। বাংলাদেশের কোনো স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ কিংবা আইনজীবী কোনো নামকরা জামায়াত নেতার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে নিজেদের ছেলে-মেয়ের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন না। কিংবা কেউ আনন্দচিত্তে বলবে না ওমুক জামায়াত নেতা আমার আবাল্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এই যে সামাজিক ঘৃণা এবং অস্পৃশ্যতার বিষয়টি কিন্তু কমছে না। বরং বাড়ছে। ১৯৭১ বা ৭২ সালে জামায়াতের প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং ক্রোধ ছিল তা ২০১৪ সালে এসে অনেক বেড়ে গেছে। জামায়াত হয়তো বলবে তাদের সংখ্যাও তো বেড়েছে। বেড়েছে ধন সম্পদ, চাকচিক্য এবং সাংগঠনিক ভিত্তি। কিন্তু যে হারে তাদের অজনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে জনপ্রিয়তা বাড়েনি। এখন প্রশ্ন হলো এটা কেন হলো?
আগেই বলেছি জামায়াত নিয়ে আমি কোনো দিন তেমন একটা ভাবিনি। কিন্তু জেলে যাওয়ার পর জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার পর দলটির অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় সম্পর্কে আন্দাজ করার সুযোগ হয়েছিল। জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে একান্ত নির্জনে আলাপ-আলোচনার সময় তাদের হতাশা, ভুলত্রুটি এবং পরিকল্পনাগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে জেল থেকে বের হওয়ার পর জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তার ফলশ্রুতিতে দলটি সম্পর্কে আমার এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আমার মনে হয় এক অনির্ধারিত গন্তব্যে অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবে জামায়াত-শিবির এগুচ্ছে। তারা জানে না তারা কী করছে! তারা এও জানে না তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? অনেকটা বেহুঁশ অবস্থায় তারা দিকভ্রান্ত পাখির ন্যায় মহাশূন্যে এলোপাতাড়ি উড়ছে, কেবল উড়ছে এবং দুনিয়ায় ফেরত আসার পরিবর্তে ঊধর্্বলোকে জান্নাতের সন্ধান করছে। নিজেদের ভেদ বুদ্ধি কোরআন হাদিস ব্যবহার না করে তারা অন্য কিছুর সহযোগিতায় চোখ বন্ধ করে শুধু ছুটছে, অজানা এক গন্তব্যের দিকে ছুটছে। এ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে রয়েছে কেবলই পরাজয়, কেবলই অপমান এবং নিশ্চিত এক ধ্বংসযজ্ঞ। সব ভাষাতেই একটি জনপ্রিয় প্রবাদ রয়েছে, সেটি হলো- যারা সৌভাগ্য এবং সুসময়কে চমৎকারভাবে কাজে না লাগায় তারাই দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে। আর যারা দুর্ভাগ্যকে চিহ্নিত করতে পারে না তাদের আমৃত্যু সেই দুর্ভাগ্যের তাড়নায় লাঞ্ছিত; অপমানিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই কবরে যেতে হয়। জামায়াতের লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমার কেবলই মনে হয়েছে তারা সুসময়টি যেমন কাজে লাগাতে পারেনি তেমনি দুর্ভাগ্যকে চিহ্নিত করে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার হয়েছে এবং আগামী দিনে আরও হবে।
জামায়াত-শিবির একবারও চিন্তা করেনি কেন লোকজন তাদেরকে ঘৃণা করে। তারা বরং উল্টোটি চিন্তা করে সকাল-বিকাল দেশ-জাতি এবং নিজেদের তকদিরের ওপর অভিমানী হয়ে হা-হুতাশ করে। তারা ভাবে এত নামাজ পড়ি, কোরআন পড়ি, সৎ জীবনযাপন করি অথচ লোকজন আমাদের নেতা না মেনে মানছে যত্তসব বেনামাজি, নাফরমান এবং অসৎ লোকদের। তারা ভুলেও একবার চিন্তা করে না ১৯৭১ সালের সব নির্মমতা, অপরাধ, লুটপাট, ধর্ষণ, গুম, হত্যা ইত্যাদির জন্য লোকজন তাদেরই দায়ী করে। পাকিস্তানি আর্মি, মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তঃবিরোধ, ভারতীয় বাহিনীর ভুল টার্গেট এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধী সব পর্দার অন্তরালে চলে গেছে। দৃশ্যপটে শুধু জামায়াত আর তাদের একটার পর একটা ভুল পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত এবং কর্ম বার বার জাতির সামনে এ কথাই প্রমাণ করেছে ‘৭১-এর সব কিছুর মূলে কেবল জামায়াতই দায়ী। জামায়াত তাদের সুসময়ে যেমন জনমতকে পাত্তা দেয়নি তেমনি বর্তমানের দুঃসময়ে একবারও অনুতপ্ত না হয়ে বরং বার বার বলছে তাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে।
আমার মাথায় ঢুকে না, শিবির কেন জামায়াতের ‘৭১-এর দায় মাথায় নিচ্ছে। ‘৬০-র দশকের চিন্তা-চেতনায় আবদ্ধ জরাজীর্ণ বৃদ্ধদের অন্যায় হুকুম, কুকর্মের বোঝা এবং পশ্চাৎপদ নেতৃত্ব দ্বারা তরুণ প্রজন্মের আধুনিকতা যদি পরিচালিত হয় তবে শিবির ধ্বংস হবে না তো কি হবে। যে মানের ছেলেমেয়েরা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাতে জামায়াতের বৃদ্ধদের উচিত আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে দল, দেশ ও জাতিকে দায়মুক্ত করা। আমি এখনো ভেবে পাই না কেন কাদের মোল্লা ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ভি চিহ্ন দেখাতে গেলেন? গোলাম আযম সারা জীবন চুপচাপ থাকলেন, কোনো দিন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিলেন না বা দুই কলম লিখলেন না সেই তিনি হঠাৎ ২০১০ সালে এসে দম্ভ করলেন কেন? টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, ‘৭১-এ তিনি সঠিক ছিলেন, ‘৭১ নিয়ে তার কোনো অনুতাপ নেই, তার কিছু হবে না, কেউ তার কিছু করতে পারবে না! আমি জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে বলব, গ্রেফতার হওয়ার আগে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের কথাবার্তা, হম্বিতম্বি এবং অহংকারমূলক আচরণ মূল্যায়ন করার জন্য। তারা কি সরকারকে প্রভোক করেনি তাদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য?
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। জয়লাভ এবং সরকার গঠনের পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হরহামেশাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু নিয়ে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। প্রতিদিনই সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে সরকারকে রীতিমতো জ্বালাতন করত। সরকার কিন্তু বহুদিন চেষ্টা করেছিল বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য না করার জন্য। সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, বিচার হবে প্রতীকী অর্থে। অন্যদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘ওদের আর কি বিচার করব! ওদের তো বিচার হয়েই গেছে। আমাদের সুবিশাল জয়ই ওদের সবচেয়ে বড় বিচার।’ সরকারের এই মনোভাবের সুফল জামায়াত-শিবির গ্রহণ করতে পারেনি। বরং সবটাই করেছে উল্টো। তারা দগদগে কাটা ঘায়ে লবণের ছিঁটা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবহমান বাংলার আবেগ-অনুভূতিতে পদাঘাত করেছে। মিডিয়ার লোকজন যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে উত্তেজনাকর কিছু পেল না তখন জেঁকে ধরল জামায়াত-বিএনপির লোকজনকে। প্রতিদিন ২/১ জন অভিযুক্ত জামায়াত নেতা বা বিএনপি নেতার বক্তৃতা, বিবৃতি, আত্দপক্ষ সমর্থনের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে থাকল। এসব কথাবার্তায় তারা বলতে চেষ্টা করল, ১৯৭১ সালে তারা কোনো অন্যায় এবং অপরাধ করেনি। তাই সরকার তাদের কিছুই করতে পারবে না। ২/১ জন তো রীতিমতো অহংকার করে সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল, পারলে বিচার করেন তো।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের উল্টাপাল্টা বক্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠল। সরকার প্রমাদ গুনল। সরকারের সহযোগী বাম সংগঠনগুলো সরকারকে যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য প্রবল চাপ দিতে থাকল। বিভিন্ন টকশো, সভা, সমিতি এবং সেমিনারে হররোজ সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা শুরু করল। এ অবস্থায় সরকার জাতিসংঘের সাহায্য চাইল। সে মতে ইউএনডিপি আইসিটি অ্যাক্ট প্রণয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল এবং ২০০৯ সালের শেষে এসে ১৯৭৩ সালের আইনটি সংশোধন হলো। এ আইন প্রণয়নে জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও সাহায্য করেছিল। তারা তিনটি রেজুলেশন পাস করে আইনটিকে সমর্থন জানিয়ে বলে যে, এর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ গুণগতমান বজায় থাকবে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনও আইনটি সম্পর্কে লিখিতভাবে ভূয়সী প্রশংসা করে। আইনের অধীন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জামায়াত-শিবির প্রথম থেকেই টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করেনি। বরং এক ধরনের সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা ও তদ্বিরের মাধ্যমে বিচারিক কাজে অংশগ্রহণ করেছে। বিএনপিও কিছু বলেনি। বরং বিচার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার গঠিত হওয়ার ১৬ মাস পরে অর্থাৎ ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এ ১৬ মাস ধরে ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য সরকার যতটা না চেষ্টা করেছে তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে জামায়াত-শিবির যাতে সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠনে বাধ্য হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বিচারপতি নিজামুল হক। তিনি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে চেষ্টা করছিলেন, বিচারটিকে আন্তর্জাতিকমানের করার জন্য। এ জন্য তিনি দেশ-বিদেশের নামকরা আইনবিদদের সাহায্য নিয়ে নিজের বিচারিক মন এবং মস্তিষ্ককে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। স্কাইপের মাধ্যমে তিনি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক আইন এবং কিছু রেফারেন্সের খুঁটিনাটি জেনে নিচ্ছিলেন। এসব বিষয় আলোচনার পাশাপাশি তিনি নিজের একান্ত কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা এবং আবেগ-অনুভূতির কথাও বলেছেন। জামায়াত-শিবিরের সাহায্যকারীরা কৌশলে সেই স্কাইপে সংলাপ রেকর্ড এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে নিজামুল হককে ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। যেদিন তিনি পদত্যাগ করলেন সেদিন জামায়াত-শিবিরের বগল বাজানোর শব্দে আর উল্লাস নৃত্যে মনে হলো তারা সবাই যুদ্ধাপরাধের বিচারে মহাবিজয় অর্জন করেছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রমাদ গুনলাম। আমার মনে হলো জামায়াত-শিবির আগামী দিনে ভয়ঙ্কর ফ্যাসাদে পড়বে। কারণ বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপে সংলাপ দেখে আমার দুটি বিষয় স্পষ্ট মনে হয়েছে। এক. তিনি পরিপূর্ণভাবে জেনেশুনে, বুঝে বিচারকার্য পরিচালনা করতে চেয়েছেন। দুই. তিনি সরকারের বহুমুখী চাপকে বার বার উপেক্ষা করে যাচ্ছিলেন। তার কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল তিনি বিচার নিয়ে সরকারের তাড়াহুড়ো পছন্দও করছিলেন না এবং পাত্তাও দিচ্ছিলেন না। কাজেই এমন একজন লোকের বিদায়ে যারা বগল বাজায় তাদের পরিণতি কেমন হবে যা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানগরিমার দরকার হয় না।
বিচারপতি নিজামুল হক এবং ব্রাসেলসে কর্মরত বাংলাদেশি অ্যাটর্নি আহম্মেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপের কথোপকথন জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেওয়া যে কত বড় ভুল হয়েছে তা এখন জামায়াত-শিবির হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ওয়েব পেইজে দেখা যাচ্ছে, তারা সে দেশে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক বলেন, জামায়াতিরা এই কাজে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। সেই লবিস্ট গ্রুপের কারণেই কি না জানি না স্কাইপের ঘটনা প্রথমে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে পৃথিবী বিখ্যাত ইকোনমিস্ট পত্রিকায়। পরবর্তীতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তা আরও বিস্তারিত প্রকাশ করে এবং সেখান থেকে একই চেইন ধরে মাহমুদুর রহমানের আমার দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ পান এবং বিজয়ের আনন্দে অন্ধ হয়ে জামায়াত-শিবির সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল প্রথম রায় দেন। জামায়াত-শিবির একটি টুঁ-শব্দও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু গোল বাধে এক মাস পরে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে যখন কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তখন তিনি ভি চিহ্ন দেখিয়ে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীকে প্রভোক করেন। ফলে সেই দিনই অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চের। উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ আর সরকার হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মানুষের আবেগের কাছে সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়। গণদাবির বিপরীতে সরকার আইসিটি অ্যাক্ট সংশোধন করেন এবং কাদের মোল্লার রায়ের ব্যাপারে উচ্চতর আদালতে আপিল করেন। তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা। প্রথমে কাদের মোল্লা; তারপর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এর পর কামারুজ্জামান, চৌধুরী মঈনউদ্দিন, গোলাম আযম, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, এ কে এম ইউসুফ, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী এবং এ টি এম আজহার দণ্ডপ্রাপ্ত হন।
উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবিরের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে আমার মনে কতগুলো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তারা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং বিচারব্যবস্থা মানেন কিনা? যদি না মানেন বা মনে করেন সরকারের নির্দেশে বিচার পরিচালিত হচ্ছে তবে উকিল নিয়োগ করে সওয়াল-জওয়াবে অংশ নিচ্ছেন কেন? যদি মানেন, তবে রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরতাল দিচ্ছেন কেন? তারা তো বাংলাদেশে এক ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করছেন! ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দিচ্ছেন আবার উচ্চতর আদালতে আপিলও করছেন। আবার সেই আপিলের রায় তাদের বিরুদ্ধে গেলে পুনরায় হরতাল দিচ্ছেন। দুনিয়ার কোনো দেশে এমন ঘটনা কোনো দিন ঘটেনি। তাদের উচিত কিউবা এবং ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে নিয়ে গবেষণা করা। কিন্তু তারা তো সেটা করবেন না কারণ ওটা করতে তো বুদ্ধি, সাহস এবং অনুপম নেতৃত্বের যোগ্যতা লাগে আর লাগে হুঁশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের হুঁশ নেই অথবা তাদের হুঁশ আছে ঠিকই কিন্তু পুরো জাতিই হয়তো বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। -লেখক : রাজনীতিক।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button