বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ধস
বাংলাদেশের সাশ্রয় হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা
সাইদুল ইসলাম: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় চলতি বছর বাংলাদেশের মোট ১৪ হাজার কোটি টাকা আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হবে। তবে কম দামে জ্বালানি তেল আমদানি করলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কমানোর কোন পরিকল্পনা নেই সরকারের। আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জ্বালানি খাতে সরকার এখনো ভর্তূকি দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুত্ কোম্পানিগুলোকে দেয়া এখন ভর্তূকির পরিমাণ সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে প্রতি ব্যারেল ৫০ মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে। যা ২০১৩ সালের জুলাইতে ছিল প্রতি ব্যারেল ১০৬ মার্কিন ডলার। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি আশংকা করছে তেলের দাম চলতি বছরেই প্রতি ব্যারেল ৩০ ডলারে নেমে যেতে পারে। মূলত: যুক্তরাষ্ট্রের তেল উত্পাদন বাড়িয়ে দেয়া এবং রাশিয়া ও ইরানের ওপর অবরোধ দেয়ার ফলে তেলের এই দরপতন।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি তেল আমদানি করে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ১০টি উত্স থেকে তেল আমদানি করে। এর মধ্যে মাত্র একটি তেল উত্পাদন করে। বাকি সবগুলোই তেল পরিবেশক। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গছে, তেলের দাম কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তেলের দাম কমে যাওয়ায় ভোক্তাদের ১২৫ বিলিয়ন ডলার বেঁচে যাবে। এই অর্থ তারা অন্যান্য খাতে খরচ করবে-যা অর্থনীতিতে চাংগাভাব ধরে রাখবে। বিশ্বব্যাপী জেট ফুয়েল (এয়ারলাইন্সগুলোর জ্বালানি) খাতে যে পরিমাণ খরচ হয় তাও কমে আসবে অনেকাংশে। এর ফলে ভ্রমণ সাশ্রয়ী হতে পারে। ফোবর্স ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী তেলের দাম কমতে থাকায় চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি চার থেকে পাঁচ শতাংশ বাড়তে পারে।
বিবিসির রিপোর্টে দেখা যায়, তেলের দাম কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ভোক্তারা খুশি। ব্রিটেনে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুবার তেলের দাম কমানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে এক গ্যালন জ্বালানি তেলের মূল্য এক পাউন্ড। আর যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস স্টেশনগুলোতে প্রতি গ্যালন জ্বালানি তেলের মূল্য দুই ডলার-যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশ যেমন চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, তেলের দাম এক শতাংশ কমলে দেশগুলোর কয়েক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়-যা তাদের বাণিজ্য ভারসাম্য অনুকূলে এনে দেয়। তবে, মূল তেল উত্পাদনকারী দেশ যেমন রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, আফ্রিকার কিছু কিছু দেশ এবং ভেনিজুয়েলা তেলের দাম কমে যাবার সাথে সাথে অনেকটা আতংকিত। এই দেশেগুলোর বাজেটের একটি বড় অংশই আসে তেল রপ্তানি খাত থেকে। অতীতে তেলের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে উত্পাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক তেল উত্তোলন কমিয়ে দিলেও বাস্তবতার নিরীখে এখন আর তা করতে পারছে না। দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখতে যে অর্থের প্রয়োজন তার অধিকাংশই তাদের আসে তেল রপ্তানির আয় থেকে। কাতারের তেলমন্ত্রী মোহাম্মদ আল সাধা বলেছেন, তেল উত্পাদন এবং বাজারজাত একটি জটিল বিষয়। আমাদেরকে খুব সাবধানে এগুতে হবে। দেশগুলো যদি উত্পাদন কমিয়ে দেয় তাহলে জাতীয় বাজেটে এর চাপ পড়বে। এক রিপোর্টে দেখা যায়, এসব দেশের অর্থনীতি তেলের ওপর কতটা নির্ভরশীল। লিবিয়ার অর্থনীতি ঠিকঠাক রাখতে হলে প্রতি ব্যারেল তেল তাদেরকে ১৮৪ ডলারে বিক্রি করতে হয়। এছাড়া ইরানের অর্থনীতির জন্য তেলের দাম ১৩১, আলজেরিয়ার জন্য ১৩১ ডলার, নাইজেরিয়ার জন্য ১৩১ ডলার, ভেনিজুয়েলার জন্য ১১৮ ডলার, রাশিয়ার জন্য ১০৫ ডলার, সৌদি আরবের জন্য ১০৪ ডলার, ইরাকের জন্য ১০১ ডলার, ইউএইর জন্য ৮১ ডলার, কুয়েতের জন্য ৭৮ ডলার এবং কাতারের অর্থনীতির জন্য প্রতি ব্যারেল তেল ৭৭ ডলারে বিক্রি করতে হবে। এর কম দামে বিক্রি করলে ওইসব দেশের অর্থনীতিতে ঘাটতি দেখা দেবে।
সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, তেলের দাম পড়তে থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাশিয়ার অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে তেলের দামের ওপর। মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ আসে তেল এবং গ্যাস খাত থেকে। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম এক ডলার করে কমলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি থাকে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। ইতিমধ্যে একবছরের ব্যবধানে দেশটির মূদ্রা রুবল মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। সেখানে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে সবাই। ব্যাংকে যাতে অর্থ মজুদ থাকে সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য ব্যাংক সুদের হার সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে একলাফে বাড়িয়ে ১৭ শতাংশ করা হয়েছে।
তেলের দাম পড়ার আগেই বড় উত্পাদনকারী দেশ ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি চাপের মধ্যে ছিল। দেশটির অর্থনীতিতে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে অবস্থান করছে। এরপরও ভেনিজুয়েলা তেলের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের ওপর ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। এক হিসেবে দেখা গিয়েছে যে, বছরে এ ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অতীতের সরকারগুলো অনেক চেষ্টা করেও এ ভর্তুকি কমিয়ে আনতে পারেনি। এবার দেশটি ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।