টুকরো টুকরো স্বপ্ন পুড়ে ছাই
‘মাইয়্যাডা ঘুমে ছিল। কম্বল গায়ে দিয়া ঘরের দরজা একটু আলগা কইরা বড় মাইয়্যারে ইশকুলে নেওয়ার লাইগ্যা বাইর হই। পথেই শুনি আগুন লাগছে। মাইনষে আমারে ঘরে ঢুকবার দেয় না। আমার মাইয়্যা তো কম্বল মুড়ি দিয়া ঘুমাইতাছে। আগুনের তাপে মনে হয় আরো ওম পাইছিল। কেউ আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইলো না। না জানি কত কষ্ট হইছে। আমার বাচ্চারে আমার কুলে আইন্যা দেন। আমি আর কিছু চাই না।’
এভাবেই বিলাপ করছিলেন আসমা। অনেক খোঁজার পরে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে ফাতেমাকে যখন ফিরে পেলেন, তখন তাকে আর চেনা যায় না। পুড়ে ঝলসে গেছে সে। লাশ কি না, তাও বোঝা যায় না। একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে ফাতেমার রিকশাচালক বাবা মেয়েকে বুকে ধরে রেখেছিলেন।
মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী রোডে জাফরাবাদ এলাকায় পুলপাড়, বটতলা বস্তি হিসেবে পরিচিত বস্তিটিতে সকাল আটটার দিকে আগুন লাগে। এই আগুনেই ফাতেমা নামের শিশুটি পুড়ে ছাই । আসমা বলছিলেন, ‘আমার মাইয়্যা আমারে মা কইয়া ডাহে না ক্যান?’
এখানে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত মানুষের টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলোও পুড়ে ছাই। ফলে অনেকে আসমাকে সান্ত¡না দিয়েই ছুটছেন নিজের পুড়ে যাওয়া ঘরটির কাছে। ফায়ার সার্ভিস পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছে। চালের পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট টিন স্তূপ করে রাখা। দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে ধোঁয়ার কু-লি। সেই স্তূপের নিচে থেকেই কেউ ট্রাংক বের করছেন। কেউ বা পুড়ে যাওয়া সেলাই মেশিন। থালা, বাটি যদি কিছু পাওয়া যায় তারও চেষ্টা কারও কারও। এখানে বসবাসকারীরা কেউ বাসাবাড়িতে বুয়া হিসেবে কাজ করেন। কেউ পোশাক কারখানার শ্রমিক। কেউ ছিলেন পিঠা ব্যবসায়ী। বলতে গেলে সবাই ছিলেন নিম্নবিত্ত। ফলে তাদের খুব বেশি বড় স্বপ্ন ছিল না। টুকরো টুকরো স্বপ্ন দেখছিলেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল বা মাদরাসায় পড়াচ্ছিলেন। কিছু কিছু সঞ্চয়ও করছিলেন। সকালে বেশির ভাগ লোক কাজের উদ্দেশে বাইরে চলে যাওয়ায় আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা কম ঘটেছে।
একেক ব্যবস্থাপকের অধীনে ২৫ থেকে ৩০টি ঘর। সেই ধরনের একজন ব্যবস্থাপক কুলসুম। তিনি জানালেন, তার ঘরসহ প্রায় ৭৫টি ঘর পুড়ে গেছে। তিনিও মেয়েকে মাদরাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে কেউ ছিল না। তবে এক ঘরের সংসারে আলমারি, ফ্রিজসহ জিনিস তো কম ছিল না। এখন সব শেষ। কুলসুম এবং সেখানে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইট, বাঁশ এবং টিন দিয়ে বানানো স্থাপনাগুলো দোতলা এমনকি তিনতলা পর্যন্ত করা হয়েছিল। এক হিসাব অনুযায়ী নিচতলায় ৪২টি এবং ওপরের তালায় ৪৪টি ঘর ছিল। এতে প্রায় ৫০০ বা তার বেশি পরিবার বাস করত। একেক ঘরের ভাড়া ছিল আড়াই হাজার টাকা বা তার বেশি। অনেকে সেখানেই মুদির দোকান দিয়েছিলেন। তাদের ঘর এবং দোকান দুটোই পুড়ে গেছে।
পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ফয়সাল একা বসে বিলাপ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঘরে ১২ হাজারের বেশি টাকা ছিল। সকালে কাজে গেছিলাম। তারপর আইস্যা দেখি শেষ। চিন্তা করতাছি খাব কী, থাকব কই।’
পোশাক শ্রমিক নাজমা পুড়ে যাওয়া ট্রাংক থেকে অনেক কষ্টে জমানো ৪০ হাজার টাকা খুঁজছিলেন। যখন পেলেন, তখন আর সেই টাকার কোনো দাম নেই। ৫০০ টাকা নেটাগুলো আবছা দেখা গেল শুধু। একজন জানালেন, বের হওয়ার সময় ছোট সাদাকালো টেলিভিশনটা তিনি শুধু বের করতে পেরেছিলেন।
আছে আহাজারি
পুলপাড় বস্তিতে অভিশাপের আগুনে শোকের মাতম বস্তি জুড়ে। শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে আহাজারি ও আর্তনাদ করছেন বস্তির অসহায় মানুষগুলো।
কিন্তু বস্তির সরুপথ ও অপর্যাপ্ত পানির কারণে যথাসময়ে আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি। অপরদিকে পুরো বস্তি ছিল বাস ও টিনের তৈরি। এছাড়া, অগণিত দাহ্য পদার্থ থাকায় চোখের পলকে বস্তিবাসীর সব কিছু শেষ করে দেয় সর্বনাশা আগুন। সহায় সম্বল বলতে কিছুই রাখেনি এ আগুন।
রেনু বলেন, পরনের কাপড় ও জানডা ছাড়া কিচ্চু নেই। সব কয়লা হইয়া গ্যাছে।’ রেনুর ঘরে ছিল ১০ হাজার টাকা, কাপড় ও সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
রেনুর পাশের বাড়িতে থাকেন আরিফ ও হালিমা দম্পতি। পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছেন। বস্তিতে তাদের ছোট একটি দোকান ছিল। দোকানের প্রায় ৫০ হাজার টাকার পণ্য ও টিভি-ফ্রিজ পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব এই দম্পতি। হালিমা বলেন, মুদি দোকানের কিচ্চু নাই, সব পুইড়া গ্যাছে। এখন আমরা কোথায় যামু, কি খামু?