ইসলাম এবং আধুনিক মানবজীবনের রক্ষাকবচ

Islamইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সব প্রাণীই মানুষের জীবনের অংশ এবং প্রতিটি প্রজাতিরই মর্যাদা প্রাপ্য। পৃথিবীতে জীবনের ‘উৎস’ যে পানি, এ বিষয়ে জোর দিতে পরিবেশবিদরা কখনো ক্লান্তিবোধ করেন না। জীবন ও পানির সম্পর্ক যে কত বেশি ঘনিষ্ঠ, এর ওপর চিরগৌরবময় আল-কুরআনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়নি আর কোনো ঐশীগ্রন্থ।
সূরায়ে আল আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আর অবিশ্বাসী যারা, তারা কি ভেবে দেখেনি যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল; তখন আমরা (আল্লাহ) উভয়কে খুলে দিলাম এবং পানি থেকে সব জীবিত বস্তু আমরা তৈরি করেছি? তারা কি এরপরও বিশ্বাস করবে না?’
সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরো বলছেন, ‘এবং আল্লাহ আকাশ থেকে পানি প্রেরণ করেন; অতএব, তিনি পানি দ্বারা মৃত্তিকাকে জীবন দেন এর মৃত্যুর পর। নিশ্চিতভাবেই এতে প্রকৃতপক্ষে নিদর্শন আছে তাদের জন্য যারা মনোযোগ দিয়ে শোনে।’ (আন্ নাহল ৬৫ নম্বর আয়াত)
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো লোক শস্য আবাদ করলেন, যা অন্য মানুষ, প্রাণী বা পাখি খেয়ে থাকে; সে ব্যক্তি বেহেশতে তার (পুরুষ বা নারী যে-ই হোন) যথাযথ পুরস্কার পাবেন। হাদিসে আরো আছে, প্রাণীকে পানি খেতে না দেয়া কিংবা বৃক্ষপল্লব ধ্বংস করা ইসলামে মারাত্মক পাপ হিসেবে গণ্য।
আধুনিক বিজ্ঞানের মেথডোলজি ও টেকনোলজির শিকড় পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে নিহিত। এটা মুসলমানদের কয়েক প্রজন্মের অবদান। ‘ইসলামি বিজ্ঞান’ নামে যা পরিচিত, এটা কখনো প্রাকৃতিক শক্তিগুলো জবরদখলের লোভী তাণ্ডব ছিল না। বরং ছিল জ্ঞান অন্বেষণের নৈতিক কার্যক্রম। প্রকৃতিসহ সমগ্র বিশ্বজগতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন উপলব্ধি করাই এর উদ্দেশ্য।
মুসলমানেরা মানবজীবনের মানোন্নয়নের উপায় হিসেবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অবদান রেখে গর্বিত। একই সাথে তারা এ কারণে স্বস্তিবোধ করে যে, প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রাণিবৈচিত্র্য বিধ্বংসী প্রযুক্তি বিকাশের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক নেই বলা চলে। আল্লাহর দেয়া সম্পদের অপচয় এবং বিশ্ব ধ্বংসের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
কানাডার মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের ডিরেক্টর আরাফাত আল আশি ‘ইসলাম ও পরিবেশ’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবন পবিত্র; তাই ‘জানের বদলা জান’ ছাড়া একে অন্যের প্রাণ হরণের নেই অনুমতি; আর ইসলামে আত্মহত্যা করা অপরাধ।’
ইসলাম জীবন ও বাস্তবতার সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে। ইহলৌকিক কিংবা পারকালীন, যা-ই হোক না কেন মানবজীবনের প্রতিটি কাজকে ধর্মের আওতায় আনা ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ ইসলাম জীবনকে দেখে সম্পূর্ণরূপে। জীবনের বিভিন্ন অঙ্গন একই মূলনীতিমাফিক পরিচালনা করতে হয়।
ইসলামি শরিয়াহ হলো আইনের সমষ্টি, যা মানুষের গোটা জীবন পরিচালনার জন্য করা হয়েছে। আলেমরা মহাগ্রন্থ কুরআন এবং আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সুন্নাহ মোতাবেক শরিয়াহর পাঁচটি প্রধান লক্ষ্য উল্লেখ করেছেন (আল তিমিমি)। লক্ষ্যগুলো হচ্ছে, ১. দ্বীন বা ধর্ম ২. নফস বা জীবন ৩. নাস্ল বা বংশধর/পরিবার ৪. আক্ল বা বুদ্ধিমত্তা/মন এবং ৫. মাল বা সম্পদ/সম্পত্তির সংরক্ষণ ও বিকাশ।
এই প্রেক্ষাপটে দায়িত্বজ্ঞানহীন যৌন সম্পর্ক ইসলামে সর্বাপেক্ষা জঘন্য ব্যাপার বলে বিবেচিত। এ ধরনের সম্পর্ক প্রায় সময়ে অবৈধ জন্ম ও শিশুহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ অবাক হয়ে বলতে পারেন, জীবন রক্ষা করাকে ধর্মরক্ষার পরে স্থান দেয়া হলো কেন? জবাব হলো জীবন রক্ষার ধারণাসহ সবকিছু ধর্ম থেকেই এসেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের পার্থিব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহর আরাধনা।
আল-কুরআনে মানবজীবনের পবিত্রতা, তথা অলঙ্ঘনীয় মর্যাদার কথা বারবার এবং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে। যেমন‘হত্যাকাণ্ডের কিংবা জমিনে অন্যায়ের বিস্তার ঘটানোর কারণ ছাড়া যদি কেউ কোনো লোককে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যা করল; আর যদি কেউ বাঁচায় একটি জীবন, যেন সে পুরো মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো’ (সূরা আল মায়িদাহ; আয়াত নম্বর-৩২)।
মানুষের জীবন যে কত মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন, তার ওপর জোর দেয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়ে উন্নত দৃষ্টান্ত আর আছে কী?
পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল সদ্যোজাত কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেয়ার লোমহর্ষক প্রথা। বর্তমান যুগে এই প্রথার ‘উন্নতি’ হয়েছে। এখন জন্মের আগেই শিশুকে মেরে ফেলা যায়। আধুনিক মানুষেরা শিশুহত্যার অপরাধকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামান্য ব্যাপার বলে মনে করে। কুরআনের কয়েকটি আয়াতে এর নিন্দা জানানো হয়েছে তীব্রভাবে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে একেবারে প্রথমে যে সূরাগুলো নাজিল হয়েছিল সেগুলোর একটিতে শেষ বিচারের দিন এবং এর আলামতের প্রসঙ্গ এসেছে। এর দু’টি আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘জীবিতাবস্থায় প্রোথিত কন্যাশিশুকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (আত্ তাকবির, আয়াত ৮-৯)
হত্যাকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে শরিয়াহ মানবজীবন রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করেছে। তবে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কেউ কারো জীবন নেয়ার অধিকার রাখে না। শরিয়াহর একটি চমৎকার বিধান হলো, নিহত ব্যক্তির পরিবার ইচ্ছা করলে ঘাতককে ক্ষমা করে দিতে পারে। তারা স্বাধীনভাবে তা করতে পারেন কিংবা প্রতীকী ক্ষতিপূরণ পেয়েও তা করা যায়।
শরিয়াহর তৃতীয় লক্ষ্য, পরিবার বা প্রজন্ম সংরক্ষণ। এটা সর্বজনবিদিত, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শরিয়াহ বিয়েকে উৎসাহিত করেছে। একই সাথে, দ্ব্যর্থহীনভাবে নিষেধ করা হয়েছে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে। ইসলাম মনে করে, মানুষের যৌনতাড়না স্বাভাবিক ও সমীচীন; এটা মন্দ কিছু নয়। ইসলাম এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং বিয়ের সাহায্যে এর সমাধান দিয়েছে।
ইসলাম চায় পরিবারকে শক্তিশালী করতে। কারণ পরিবারের বাইরে শিশুর রক্ষাকবচ নেই। শৈশবে মাতা-পিতার আদর-যত-পরিচর্যা একান্ত অপরিহার্য। অতএব পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়, এমন কার্যকলাপ মারাত্মক অপরাধ। এর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ও শিশুহত্যার মতো পরিস্থিতি দেখা দেয় অবৈধ যৌনসম্পর্কের ফলে। এই ঘৃণ্য অপরাধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ লঙ্ঘিত হয় এবং এর যথাযথ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ‘আধুনিক’ সমাজে বিশেষ করে পাশ্চাত্যে অবাধ যৌনাচার এবং এ ব্যাপারে কারো কাছে জবাবদিহিতা না থাকাই ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম এটাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।
যেকোনো সমাজের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের সুরক্ষা জরুরি। পরিবার প্রথার ভাঙনেই পশ্চিমা সমাজে এত অপরাধ এবং ক্রমবর্ধমান মানসিক সমস্যা (যা আত্মহত্যাও ঘটিয়ে থাকে)। পরিবার ভেঙে পড়লে সন্তানদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টি হয়। এর চূড়ান্ত পরিণাম সামাজিক বিপর্যয়। তাই ব্যক্তি, সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ জীবননির্বাহের জন্য পরিবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রফেসর শাহুল হামিদ, ভারতের কেরালার ইসলামিক মিশনের প্রধান, কালিকট ভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের সাবেক শিক্ষক, ইসলাম অনলাইন-এর কনসালট্যান্ট এবং গ্রন্থকার।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button