মুসলমানদের প্রয়োজন যে আধ্যাত্মিকতা
তারিক রামাদান: ইসলামের কথা বলতে গেলে এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজগুলোতে আধ্যাত্মিকতার ঘাটতি রয়েছে। কথিত ধর্ম নয়, আধ্যাত্মিক জীবনের অভাব। ইসলামপন্থী, সেকুলার ও সাধারণ নাগরিক সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে পারে। ধর্ম বুঝায় প্রথা-পার্বণের কাঠামো এবং বিশ্বাসীদের অধিকার ও দায়িত্ব।আবার ধর্ম সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।
কালোত্তীর্ণ ইসলামি ঐতিহ্য মোতাবেক, ধর্মের কাঠামো, সূত্র ও অনুসরণের মতো বিষয়কে দেখতে হবে ঐশীশক্তি, জীবন ও মৃত্যুর ধারণা, মন ও হৃদয়ের সাথে এগুলোর সম্পর্কের আলোকে। বর্তমান যুগে ইসলামি আলোচনা-পর্যালোচনা প্রায় সময়ে এর তাৎপর্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্যের উপলব্ধি হারিয়ে ফেলছে। এটা ক্রমবর্ধমান হারে নিছক প্রতিক্রিয়ামূলক হয়ে যাচ্ছে, যেখানে বিশ্বাসীদের নৈতিকভাবে রক্ষা সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। আধ্যাত্মিকতা ধর্মবিহীন বিশ্বাস নয়। এটা হলো ধর্মের সারবস্তু হিসেবে শান্তির সন্ধান। এই প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে ঐক্য ও শান্তির ঘাটতি রয়েছে অনেকটাই। তাই আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় মুক্তি অর্জনের সময় এসেছে।
ইসলামি সভ্যতার পতনের পর উপনিবেশবাদ কর্তৃত্ব করেছে। এর ছাপ রয়ে গেছে আজো। অবশ্য তার পাশাপাশি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অভিজ্ঞতাও আছে আমাদের। ইসলামকে বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ গড়ে উঠেছে সেই প্রতিরোধের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। গতানুগতিক মুসলিম পণ্ডিত বা আলেমসমাজ এবং ইসলামি আন্দোলন, উভয়ের বেলায় দেখা যায়Ñ নৈতিক ধ্যানধারণা, খাদ্য ও পোশাকসংক্রান্ত বিধান এবং আচার-প্রথা পালনের কঠোরতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরার প্রেরণা থেকে। আরব বিশ্বে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ ও বৈরিতার বিপদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা যতটা ঘটেছে ততই এই স্বাতন্ত্র্য উপস্থাপনের চেতনা বেড়েছে।
ধর্মীয় আচরণের যে আধ্যাত্মিক সারবস্তু, তার দিকে ইসলামি আন্দোলনগুলোর মনোযোগ কমে গেছে রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে। এক দিকে গতানুগতিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান, অন্য দিকে কঠোরতা অবলম্বনকারী কিংবা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সদা তৎপর ইসলামি আন্দোলন এই দুইয়ের মাঝে সাধারণ মুসলিম নাগরিকেরা ঈমান, অন্তঃকরণ ও শান্তির ব্যাপারে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের জবাব পাচ্ছেন কমই।
এক ধরনের শূন্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার ‘সুফি’ আন্দোলনগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটছে। তাদের কোনোটি ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখে; কোনোটি মানুষকে করছে প্রতারিত। ‘সুফি’দের নানা ধরন ও বৈশিষ্ট্য। প্রায় ক্ষেত্রে তারা সাংসারিক জীবন থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। এটা আচার-প্রথানির্ভর গতানুগতিক ইসলাম এবং ইসলামপন্থীদের আন্দোলন এ দু’টিরই বিপরীত। সুফিবাদীদের বক্তব্য হলো, ‘আপনার সত্তার দিকে তাকিয়ে দেখুন; অন্তকরণ ও নিজের শান্তির দিকে মনোযোগী হোন; অর্থহীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে অনেক দূরে থাকুন।’
সুফিবাদী গ্রুপগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শিক্ষিত অভিজাত এবং সবচেয়ে দরিদ্র উভয় ধরনের মানুষকেই একত্র করছেন। এভাবে শিক্ষিতরা খোঁজেন মানবজীবনের তাৎপর্য, আর দরিদ্রতম লোকজন এক ধরনের কুসংস্কারের কাছাকাছি পৌঁছে যান। সুফিবাদীদের শিক্ষা ও মতাদর্শ ভাববাদী। জীবনবাস্তবতার জটিল বিভিন্ন বিষয় থেকে তারা বহু দূরে। তার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তারা মাঝে মধ্যে শাসক গোষ্ঠীর প্রতি পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ সমর্থন জানান। এমনকি একনায়কদের সমর্থন করার ঘটনাও ঘটেছে।
অধিকন্তু সুফিবাদীদের একটা বড় অংশ মুরশিদ বা গুরুর ব্যক্তিত্ব-বন্দনা আর মুরিদদের মানসিকভাবে শিশু বানিয়ে রাখার প্রথা গড়ে তুলেছেন। এই মুরিদরা উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। কিন্তু তারা হৃদয়-মনই শুধু নয়, জীবনও সঁপে দেন মুরশিদের হাতে। বলা হয়ে থাকে, মুরশিদ মানবজীবনের পরিপূর্ণতা অর্জনের পথের প্রতীক। তবে এই ধারা মানুষের ক্ষমতায়নের বিপরীতে একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলছে, যা বর্তমানে অনেকের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুফিবাদের অতি ভক্তির বিষয় অস্বস্তিকর, এমনকি বিপজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে।
অনেকেই আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করতে চান। কিন্তু সে দীক্ষা যেন মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। অহংয়ের ওপর কর্তৃত্ব করে ব্যক্তিজীবন ও সামষ্টিক জীবনের মাঝে সমন্বয় আনতে হবে। বাস্তবে আমরা যা দেখছি তা হলো সমান্তরাল দু’টি জীবন। এক দিকে ‘সুফি’দের আধ্যাত্মিকতা; তার পাশাপাশি লোভ, স্বার্থসর্বস্ব ও অনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণ। আরব এলিট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং তাদের সাথে, সামাজিকভাবে ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীও এ অবস্থাকে সুবিধাজনক মনে করে।
ধর্মীয় রীতি, প্রথা, আনুষ্ঠানিকতার অতিরিক্ত চাপ এবং শুধু রাজনীতির মধ্যে ডুবে থাকা এই দু’টির মাঝে মানুষ সংস্কৃতি ও ধর্মের সূত্রে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে। সুফিদের দর্শন কোনো কোনো সময়ে সমাধান দেয়। তবে বাস্তব জীবনে কখন এর কী প্রভাব পড়ছে, তা বিবেচনা করা খুব গুরুত্ববহ। সুফিবাদের নামে যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা যে প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য ফলপ্রসূ তা নয়। এ দিকে ধর্মের গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আচার-অনুষ্ঠানের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে এবং নিষেধাজ্ঞাগুলোকে বড় করে দেখায়। অপর দিকে বিদেশী প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকে নিছক প্রতিক্রিয়াবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার ভিড়ে আধ্যাত্মিক বিবেচনা যেন হারিয়ে না যায়। ক্ষমতার লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে আমরা মাঝে মধ্যে ধর্মের তাৎপর্য আর অনুসন্ধান করি না।
চার দিকে যে আদর্শিক শূন্যতা, তার জবাবে সুফিবাদীরা শুধু অন্তর্মুখী হয়ে পড়ায় তাদের চার পাশে গড়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি; সামাজিক ও রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা এবং দায়িত্ববোধের অভাব। এসব থেকে এই ভুল ধারণা হতে পারে যে, আধ্যাত্মিকতা সক্রিয়তার বিপরীত। তবুও এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, সুফি গ্রুপগুলোর একটা বিরাট অংশই সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে মুখ খুলছে। তাদের অনুসারীদের উৎসাহ দিচ্ছেন এসব বিষয়ে বক্তব্য দিতে এবং সক্রিয় হতে।
সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এখন কী করণীয়? দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য কী করা চাই? প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে সে আধ্যাত্মিকতা সুবিস্তৃত, তাকে পুনরাবিষ্কার ও পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই আধ্যাত্মিকতা যথাক্রমে ইহুদি, খ্রিষ্ট ও ইসলামি ঐতিহ্য। বর্তমান কালের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে উপেক্ষা করা চলে না। ব্যক্তি, নাগরিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণ ব্যতিরেকে কোনো সমাজে গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ টেকসই হতে পারে না।
ভাষান্তর মীযানুল করীম, (গালফ নিউজের সৌজন্যে)