যালিমের পরিচয় এবং তা সনাক্তকরণে আল-কুরআনের বাণী
অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা গাজী রুহুল আমীন: প্রারম্ভিকা: সমগ্র পৃথিবী আজ অশান্ত। আমাদের মাতৃভূমিও তুলনামূলকভাবে একেবারে কম নয়। বর্তমান সময়ে তো দেখছি, মানুষ মানুষের ওপর হামলে পড়ছে, হত্যা করে একজন অন্যজনের লাশের ওপর আমোদ-উল্লাস করছে, অবুঝ শিশু মায়ের কোলে দুধ পান করতে করতে ঘুমানোর স্থলে গোলা-বারুদের কঠিন আঘাতে নিষ্প্রাণ হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হচ্ছে, নির্যাতনে প্রাণ ওষ্ঠাগত হৃদয়ে পানির জন্য আর্তনাদ উঠলে মুখের ওপর প্রশ্রাব করার দৃষ্টান্ত পরিদৃষ্ট হচ্ছে, জীবন্ত মানুষকে গলায় রশি পরিয়ে হেঁচড়ানো হচ্ছে, ফেলানীদেরকে কাঁটাতারে ঝুলানো হচ্ছে, মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে, জাতীয় চত্বর রক্ত চত্বরে রূপান্তরিত হচ্ছে, নর্দমায় মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে, এ ছাড়াও মর্মান্তিক আরো কত কী? সবমিলে একদিকে কতকের উল্লাস ও কর্মের বাহাদুরী অন্যদিকে শত-সহস্র মানুষের গোঙানি এবং বুকফাটা আর্তনাদে মানবতা আজ বলীর পাঁঠায় পরিণত হয়ে পড়েছে। এ সবকিছুই সংঘটিত হয়ে থাকে মূলতঃ যুলুমের ছোবলে। আর যারা তা করে তাদেরকে যালিম এবং যাদের প্রতি তা করা হয় তাদেরকে মাযলূম বলে। একটি পৃথিবীকে মহা শ্মশান বানাতে বেশি নয় মাত্র একজন যালিমই যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু সেখানে তো দেখছি তা আজ সম্পূূর্ণ জালিমপুরীতে পরিণত হয়ে পড়েছে। ফলে মাযলূমের আর্তনাদ প্রমোদ ও উল্লাসের বিষয়ে পরিণত হওয়াই স্বাভাবিক। সবকিছু দেখে-শুনে নিরবীদের একটিই প্রশ্ন! কেন আমাদের এ করুণ অবস্থা? কেন-ইবা আমাদের এ কঠিন পরিণতি? আর এর শেষ-ই বা কোথায়? আসলে এ কথার জওয়াব একটাই। আর তা হলো, সকলকে যুলুম থেকে ফিরে থাকা এবং যালিমকে সংঘবদ্ধভাবে সম্বারণ করা। তাহলেই দেশ ও পৃথিবীর সকল অশান্তি দূর হবে এবং তা ভূস্বর্গে পরিণত হবেই হবে নিশ্চয়।
যালিম-এর পরিচিতিঃ যালিম শব্দটি আরবী। ‘আয-যুল্মু’ মাসদার বা শব্দমূল থেকে উদ্গত। যার আভিধানিক অর্থঃ “অত্যাচার করা, উৎপীড়ন করা, নিপীড়ন করা, নির্যাতন করা, দুর্ব্যবহার করা।” পরিভাষায়ঃ যে সমস্ত মানুষ কারো প্রতি অত্যাচার, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার করে তাদেরকে যালিম এবং যাদের প্রতি তা করা হয় তাদেরকে মাযলূম বলে।
ইলমুছ-ছরফ বা আরবী শব্দ প্রকরণ অনুসারে ‘আয-যুল্মু’ শব্দটি ক্রিয়াবাচক, যালিম শব্দটি কর্তৃবাচক এবং মাযলূম শব্দটি কর্মবাচক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। কারো কারো মতে- যুলুম শব্দের অর্থঃ আল-যাওরু (অত্যাচার করা) বা আদামুল ইনসাফ (অবিচার করা)।” পরিভাষায়ঃ কোন বস্তুকে তার উপযুক্ত স্থানে না রেখে বরং অন্যস্থানে রাখাকে যুলুম বলে। আর অত্যাচারীকে যালিম এবং অত্যাচারিতকে মাযলূম বলে। ‘তাফহীমুল কুরআন’-এর পরিভাষায়ঃ যুলুম বলা হয় অধিকার হরণকে। যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালিম এবং যার অধিকার হরণ করা হয় সে তো মাযলূম।
যালিম সনাক্তকরণে মহান আল্লাহ্র বাণী: পৃথিবীতে যালিমের সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, কেউ নিজেকে কখনোই যালিম বলে স্বীকার করবে না। যদি রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় তারপরেও সে তা স্বীকার করবে না। বরং সব সময়েই সে দারাজ কণ্ঠে নিজেকে মহামানব বলে দাবী করতেই থাকবে। তার হাতে তো ক্ষমতা থাকবে বলে কেউ তাকে যালিম বলার দুঃসাহসও করবে না। এ কারণে যুলুম কি? তা যেমন বোঝা মুশকিল ঠিক তেমনই যালিম কে? তাকেও তেমনই চেনা বড় দুঃসাধ্য। ফলে মাযলুমের চোখের পানি কখনোই বন্ধ হবে না; বরং তা নীরবে ঝরতেই থাকবে। তবে এ বিষয়ে আল-কুরআন অধ্যায়ন করলে যুলুমের বিষয়গুলো সম্পর্কে যেমন সুস্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে তেমনই যালিমদের সম্পর্কেও নিক্ষুত এবং সন্দেহাতীত জ্ঞান হাসিল হবে। ফলে গলাবাজি করে কোন যালিমের আর আত্মগোপন করার সুযোগ থাকবে না। যেমন-
(এক) যালিম হলো আত্ম অবিচারকারী বা নিজের প্রতি যুলুমকারী। এ অর্থে কুরআন মাজীদের একটি উদাহরণ, “(সুলায়মান (আঃ)-এর দরবারে উপস্থিত রাণী বিলকিসকে) বলা হলো, এ প্রাসাদে প্রবেশ করো। যখন সে তাতে প্রবেশ করতে অগ্রসর হলো তখন তা দেখল, যেন এক গভীর জলাশয়ই এবং সে তার পদদ্বয় অনাবৃত করতে থাকল। এ সময় তাকে হযরত সুলায়মান (আঃ) বললেন, এটা তো স্বচ্ছস্ফটিকম-িত প্রাসাদ মাত্র। তখন সে নারী বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো আত্মঅবিচার বা নিজের প্রতি যুলুম করতে চলছিলাম। (অর্থাৎ প্রাসাদের মেঝে স্বচ্ছ কাঁচমন্ডিত ছিল। দেখতে পানি বলে ভ্রম হতো। সে কারণে রানী বিলকিস কাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিল।) আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।” (সূরা-২৭, নামল-৪৪) আলোচ্য আয়াতে কারীমা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যালিম হলো আত্ম অবিচারকারী।
(দুই) যালিম সে তো নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণকারী। এ অর্থে কুরআন মাজীদের একটি আয়াত, “যদি আপনি আহলে কিতাবদের কাছে সমুদয় নিদর্শন উপস্থাপন করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নিবে না এবং আপনিও তাদের কিবলা মানেন না। আপনার নিকট জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনি সে সব যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (সূরা-২, বাক্বারা-১৪৫) এখানে নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণকারীদেরকে যালিম বলে অবিহিত করা হয়েছে।
(তিন) যালিম হলো আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অংশীদার স্থাপনকারী। এ অর্থে আল্লাহ্ তা’আলার একটি বাণী, “স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে স্বীয় পুত্রকে বলেছিল, হে আমার ছেলে! আল্লাহ্র সাথে কোন শরিক স্থাপন কর না। নিশ্চয়ই শিরক অতি বড় ধরনের যুলুমই বটে।” (সূরা-৩১, লুকমান-১৩) এখানে শিরককে বড় ধরনের যুলুম এবং সে কারণেই শিরক সাব্যস্তকারী মুশরিককে যালিম বলা হয়ে থাকে। আর মাটি, বৃক্ষ এবং শিরকের সমুদয় বস্তুই হচ্ছে মূলতঃ মহান আল্লাহ্র সৃষ্টি। পূজিত হওয়ার জন্য এদের কোন আগ্রহ, আদেশ অথবা কোন অনুরোধ ছিল না বরং পূজকেরাই তাদেরকে তাদের সৃষ্টি কর্তার মুখোমুখি করে দিয়েছে বলে এ সৃষ্টি বস্তুসমূহ হচ্ছে মাযলূম।
(চার) যালিম হলো আল্লাহ্ তা’আলার বিধানের বিপরীত বিচার-ফায়সালাকারী। এ অর্থে কুরআন মাজীদের একটি আয়াত, “আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গুনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফায়সালা করে না তারাই যালিম।” (সূরা-৫, মায়িদা-৪৫) এখানে যালিম অর্থঃ আল্লাহ তা’আলার অবতীর্ণ কিতাবের বিপরীতে অন্য কোন বিধি-বিধান দ্বারা সমাজে বিচার-ফায়সালাকারী বা তা রচনাকারী।
(পাঁচ) যালিম হলো, যারা সাক্ষ্য গোপনকারী তথা প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস বিষয়কে উল্টিয়ে ফেলে মিথ্যার বেশাতি তৈরি করে। এ অর্থে আল্লাহ্ তা’আলার একটি বাণী, “অথবা তোমরা কি বলছো যে, নিশ্চয়ই ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব (আঃ) ও তাদের সন্তানগণ ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন? আপনি বলে দিন, তোমরা বেশি জান, না আল্লাহ বেশি জানেন? যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে?” (সূরা- ২ বাক্বারা-১৪০) এক্ষেত্রে কোন মামলার বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, বিচারক এবং সরকার প্রধান যে কেউই বিচার-ফায়সালায় বা যে কোন বিষয়ে প্রকৃত সত্য ও প্রত্যক্ষ বিষয়ের বিপরীতে ইস্তিকামাত হবে তারাই মূলতঃ সাক্ষ্য গোপনকারী এবং কুরআন মাজীদে তাদেরকেই যালিম বলে অবিহিত করা হয়েছে।
(ছয়) যালিম হলো, আল্লাহ তা’আলার আদেশ অমান্যকারী। এ অর্থে কুরআন মাজীদের আয়াত, “এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু তোমরা কখনোই এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। তাহলে তোমরা যালিমদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” (সূরা-২ বাক্বারা-৩৫) হযরত আদম (আঃ) শয়তানের কুমন্ত্রণায় উক্ত আদেশটি লঙ্ঘন করে যালিম সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এ কথা তাঁর বক্তব্যের দ্বারাই তো প্রমাণ করে। যেমন এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ্র বাণী, “তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তো আমাদের নিজেদের প্রতি যুলুম করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদেরকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহ না করো তাহলে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো।” (সূরা-৭, আ’রাফ-২৩) অত্র আয়াতে কারীমা দ্বারা যালিম বলে আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ অমান্যকারীকে বুঝানো হয়েছে।
(সাত) যালিম হলো, উপহাসকারী, কাউকে অন্যায়ভাবে দোষারোপকারী এবং অন্যকে মন্দনামে আহ্বানকারী। এ অর্থে আল্লাহ্ তা’আলার বাণী, “হে মু’মিনগণ! কোন পুরুষের অপর কোন পুরুষকে উপহাস করা উচিত নয়। কেননা, যাকে উপহাস করা হলো সে তাদের থেকে উত্তমও হতে পারে এবং কোন নারীর অপর কোন নারীকেও উপহাস করা উচিত নয়। কেননা, যাকে উপহাস করা হলো সে উপহাসকারিনী থেকে উত্তমও হতে পারে। তোমরা তোমাদের একে-অপরের প্রতি দোষারোপ করবে না এবং তোমাদের কাউকে মন্দ নামে ডাকবে না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নামে ডাকা বড় পাপের কাজ। যারা এর থেকে ফিরে থাকবে না তারাই তো যালিম।” (সূরা-৪৯, হুজরাত-১১) অত্র আয়াতে কারীমায় যালিম বলে উপহাসকারী, কাউকে অন্যায়ভাবে দোষারোপকারী এবং অন্যকে মন্দ নামে আহ্বানকারীকে বুঝানো হয়েছে।
(আট) যালিম হলো, আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী অথবা তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কুরআন মাজীদকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। এ অর্থে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণী, “তার থেকেও বড় যালিম আর কে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যাচার করে অথবা সত্য তার সামনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? জাহান্নামই কি এ ধরনের কাফিরদের অবাসস্থল নয়?” (সূরা-২৯, আনকাবুত-৬৮) অত্র আয়াতে কারীমা দ্বারা মহান আল্লাহর ওপর মিথ্যাচারকারীকে যালিম বলে অবিহিত করা হয়েছে।
(নয়) যালিম হলো, আল্লাহ তা’আলার ঘরে তারই নাম স্মরণে বাধা দানকারী এবং তা ধ্বংস সাধণে প্রচেষ্টাকারী। এ অর্থে মহান আল্লাহ্র বাণী, “তার থেকেও বড় যালিম আর কে, যে মানুষকে আল্লাহ তা’আলার মসজিদে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণে বাধা প্রদান করে এবং তা ধ্বংস সাধণে প্রচেষ্টা করে বেড়ায়? এ ধরনের লোকদের ইবাদাতের ঐ সমস্ত স্থানে ঢোকাই উচিত নয়। আর যদি যায় তাহলে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়ই যেন যায়। তাদের জন্য পার্থিব জীবনে অপমান, লাঞ্চনা এবং পরকালীন জীবনে ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে।” (সূরা-২, বাক্বারা-১১৪) অত্র আয়াতে কারীমায় আল্লাহ্র ঘর তথা মসজিদসমূহে যারা আল্লাহর ইবাদাত, তিলাওয়াত এবং জিকির-আজকারে বাধা প্রদান করে তাদেরকে যালিম বলা হয়েছে। এরই স্বপক্ষে অন্য একটি আয়াতে কারীমা নি¤œরূপ- “আর কাফিররা বলে তোমরা এ কুরআন শ্রবণ করো না এবং এর আবৃত্তিতে হট্টগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হও। আমি অবশ্যই কাফিরদেরকে কঠিন আযাব আস্বাদন করাব এবং আমি অবশ্যই তাদেরকে তাদের মন্দ ও হীন কাজের প্রতিফল দিব। এটা আল্লাহ্র শত্রুদের শাস্তি- জাহান্নাম। তাতে তাদের জন্য রয়েছেছে স্থায়ী আবাস, আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করার প্রতিফলস্বরূপ।” (সূরা-৪১, ফুসসিলাত-২৬-২৮)
(দশ) যালিম হলো, সুদভিত্তিক অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন ইত্যাদি পরিচালনাকারী। এ অর্থে মহান আল্লাহ্র বাণী, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি প্রকৃত পক্ষে মু’মিন হয়ে থাকো, আর যদি তা না করো তবে জেনে রেখো, এটা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এখনও যদি তাওবা কর এবং সুদ ছেড়ে দাও তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা যুলুম করবে না তাহলে তোমাদের ওপরও যুলুম করা হবে না।” (সূরা- ২, বাক্বারা ২৭৮-২৭৯) প্রোক্ত আয়াতে কারীমায় সুদখোর এবং সুদের সাথে কোন না কোন উপায়ে জড়িতদেরকে যালিম বলা হয়েছে।
(এগার) যালিম হলো, সে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি- যারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নারের’ পানে তথা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র বাণী, “অতঃপর আমি তাকেও তার সৈন্যবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখে নাও, যালিমদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল। আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে ছিলাম আর তারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নারের’ পানে আহ্বান করতো। কিয়ামতের দিন তারা সাহায্য প্রাপ্ত হবে না।” (সূরা-২৮, ক্বাসাস-৪০-৪১) কাজেই যেসব নেতা-নেত্রী খোদাদ্রোহীর পথে মানুষকে আহ্বান করে ও পরিচালিত করে, তারাই যালিম। অত্র বাণীতে ‘নার’ বলতে ভয়াবহ জাহান্নামকে বুঝানো হয়েছে। শাব্দিক অর্থ ‘আগুন’। কুরআন মাজীদে শব্দটি মোট ১২৬ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
(বার) যালিম হলো তারা- যারা মানুষকে আল্লাহ্র পথে চলতে বাধা প্রদান করে, তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করে এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করে। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদের ঘোষণা, “যারা আল্লাহ্র পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয়, সে পথকে বাঁকা করে দিতে চায় এবং আখিরাত তথা আল্লাহ্র দরবারে প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করে।” (সূরা-১১, হুদ-১৯) সুতরাং যারা আল্লাহ্র পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয়, তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করে এবং আখিরাতকে অস্বীকার করে তারাই যালিম।
(তের) যালিম হলো, ভূমিদস্যু। অর্থাৎ যারা গায়ের জোরে অন্যের ভূমি দখল করে নেয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রাসূল (সাঃ)-এর বাণী, “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে যুলুমের পথ অবলম্বন করে কারোর এক বিঘাত পরিমাণ জমি আত্মসাৎ করে কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক যমীন ঝুলিয়ে দেয়া হবে।” (বুখারী-২৯৫৯) কাজেই ভূমি দখলকারীরা যালিম।
(চৌদ্দ) লাঠি বা ছড়ি দ্বারা মানুষকে প্রহারকারী দলও যালিম। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী মুহম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি ঘোষণা, “দু’টি দল জাহান্নামের ভয়াবহ ‘নারের’ অধিবাসী। আমি তাদেরকে দেখছি না। তাদের একটি দল যাদের সাথে ‘সিয়াত’ থাকবে যা গাভীর লেজের মতো বড় ঢকসই হবে এবং তা দিয়েই মানুষকে প্রহার করবে।” অত্র হাদীসের শব্দ সিয়াত এর আভিধানিক অর্থঃ “মা ইউদরাবু বিহি মিন যালদিন” “চাবুক, কষা, কষাঘাত, বেত্রাঘাত।” এটি কোন বে-আইনী বা অবৈধ লাঠি বা অস্ত্র নয়। যা কোন সন্ত্রাসী বা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ব্যবহার করার আইনগত অধিকার রাখে না। যেমন ইসলামী শরী’আয় ‘সিয়াত’ শরয়ী দ- এবং তাজীরাত প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে এটি একটি সরকারি বৈধ্য লাঠি বা অস্ত্র। অন্যদিকে সাধারণ আইনে সিয়াত বলতে ছড়ি, বুলেট, ফাঁসী কার্যকর করতে ব্যবহৃত বিশেষ রশি, অধিকার প্রতিরোধে গরম পানি, বিকট আওয়াজ দানকারী যন্ত্র, বিষাক্ত গ্যাস, এসিড ইত্যাদি সরকারি ব্যবহার্য অস্ত্রকেই বলা হবে। এগুলো সরকার ব্যবহার করবে তবে তা সর্বসাধারণের জন্য বৈধ নয়। এ বৈধ ছড়ি বা লাঠি জাতীয় বস্তু বা অস্ত্র দ্বারা যে সমস্ত সরকার প্রধানগণ অথবা তাদের আদেশের অধীনরা অবৈধভাবে মানুষকে গণহারে পিটায়, হত্যা করে চাই তা কারো আদেশে অথবা স্ব-উদ্যোগে অতি উৎসাহী মেযাজে হোক তারা অবশ্য অবশ্যই যালিম হবে।
(পনের) যালিম হলো, যারা ধর্মের ব্যাপারে মু’মিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারী ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলার বাণী, “আল্লাহ তো তোমাদেরকে কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন। যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেছে এবং তোমাদের বহিষ্করণে সাহায্য করেছে। এ ধরনের লোকদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই যালিম।” (সূরা-৬০, মুমতাহানা-৯) অত্র আয়াতে কারীমায় যারা দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ফাসাদ এবং অনৈতিক কর্মকান্ড চালায় এদের সাথে যারা সম্পর্ক, সমর্থন, এবং সাহায্য-সহযোগিতা করে তারদেরকে যালিম বলা হয়েছে।
(ষোল) ঈমানের মুকাবালায় কুফরকে শ্রেয় জ্ঞান করে যে পিতা মাতা এবং ভাইরা, মু’মিন সন্তানের জন্য উক্ত পিতা-মাতাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করাও যালিমের হুকুম রাখে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলার বাণী, “হে মু’মিনগণ! তোমাদের পিতা-মাতা এবং ভাইরা ঈমানের মুকাবালায় যদি কুফরকে শ্রেয় জ্ঞান করে তাহলে তাদেরকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারই যালিম।” (সূরা- ৯, তাওবা-২৩)
সারকথায়, যুলুম ব্যাপকার্থক একটি শব্দ। আল্লাহ্ তা’আলার নাফরমানী, অবাধ্যতা, সীমাতিক্রম, কিংবা কারোর নিজের প্রতি অথবা অন্য কোন মানুষের প্রতি অন্যায়-অবিচার, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, দুর্ব্যবহার এবং যে কোন মাখলুকাতের প্রতি প্রকৃত অধিকার হরণ বা তার যথোপযুক্ত স্থানে না রাখাকে যুলুম এবং যে ব্যক্তি তা সম্পাদনকারী তাকেই যালিম বলে।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, কুমারখালী, পোঃ উপজেলা ও জেলা পিরোজপুর।