জার্মানিতে কেন অভিবাসন মুসলিম বিরোধী বিক্ষোভ
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল ইংরেজি নববর্ষের ভাষণে বলেছেন, জার্মানির উচিত ইউক্রেন, ইরাক ও সিরিয়া থেকে যুদ্ধ ও মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের সাহায্য করা। তিনি আরো বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যারা আমাদের কাছে আশ্রয় চায় তাদের সাহায্য করা উচিত।
চ্যান্সেলরের এই বক্তব্য তার সাম্প্রতিককালের অভিবাসনবান্ধব নীতিরই অংশ বলে উল্লেখ করেছেন, বার্লিনের হ্যামপেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভেদ ও সামাজিক দ্বন্দ্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোকসি ইয়ুরডাকুল। তিনি আরো বলেন, মার্কেল তার দলকে বহুমুখী সামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
সে যাই হোক, অনেক জার্মান পরিবর্তনের বিষয়ে আগ্রহী নয়। দেশটির পূর্বাঞ্চলের স্যাক্সনি রাজ্যের রাজধানী ড্রেসডেনে প্রতি সোমবার বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন তাদের অসন্তুষ্টি জানাতে। পেগিদা নামক অভিবাসন বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা এসব বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করছে। সমালোচকেরা তাদের ‘নগ্ন নাৎসী’ বলে থাকেন। গ্রুপটির পুরো নামের মধ্যেই তার নীতি ও দর্শনের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, তাহলো : ‘প্যাট্রিওটিশে ইউরোপিয়ার জিজেন ডাই ইসলামাসিরাং ডেস আবেন্ডালান্ডেস বা প্যাট্রিয়টিক ইউরোপিয়ান্স এগেইনিস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অব দ্য ওয়েস্ট’ (পাশ্চাত্যের ইসলামীকরণ বিরোধী দেশপ্রেমিক ইউরোপিয়রা)। জার্মানির অন্যান্য শহরের তুলনায় ড্রেসডেনে অভিবাসীদের সংখ্যা খুবই কম। তাহলে কেন এই শহরটিই এমন একটি প্রতিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে?
ইয়ুরডাকুল বলছেন, ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব জার্মানির একটি শহর ও রাজধানী হওয়ার কারণে ড্রেসডেন অনেক রাজনৈতিক উৎপীড়নের শিকার হয়েছে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের আগে তারা বহু সমস্যা ও সুবিধা ভোগের সুযোগ পেয়েছে। এই কারণে ড্রেসডেন বড় ধরনের যেকোনো সামাজিক পরিবর্তনের বিরোধী। মূলত এই কারণেই তারা রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে ইচ্ছুক নয় বলে মনে করেন ইয়ুরডাকুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্রেসডনে অনেক বেশি বোমা ফেলা হয়েছিল এবং সেখানে তারা শুধু তাদের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকেই হারায়নি, তারা তাদের পরিবার-পরিজন ও সম্পদও হারিয়ে ছিল। এ কারণে তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে সেই ভীতি লালন করে চলেছে।
ইয়ুরডাকুল মনে করেন যে, এখানকার মানুষ মনে করে যে, তাদের কথা, চিন্তা ও উদ্বেগ রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো তাদের সম্মতি ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিও তাদের ক্রোধ বেড়েই চলেছে। কারণ ইইউ একচ্ছত্রভাবে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে তারা মনে করছে। এই বিষয়টিকে রাজনীতির বাইরে রাখার জন্যই ইয়ুরডাকুলের ভাষায় মার্কেল তার নতুন ‘অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্র্থী বান্ধব রাজনীতি’ শুরু করেছেন। তিনি তার লক্ষ্যের ক্ষেত্রে চরম ডানপন্থীদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই বিষয়টি তার দল ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) অনেক রক্ষণশীল অনুসারীকে ‘হতাশ’ করেছে। কয়েক বছর আগেও সিডিইউ-দলের নিকট থেকে ধরনের কথা শোনা যায়নি।’ তারা মূল ধারায় চলে আসায় চরম ডানপন্থী অন্য দলগুলো সে শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। ইয়ুরডাকুল এএফডি নামক রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করেন। তারাও অভিবাসন বিরোধী এবং পেগিদা আন্দোলনকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন দিয়েছে। বিক্ষোভের সামনে পেগিদা থাকলেও বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের মূল অংশ এসেছে মূলত এএফডি সমর্থক, মার্কেলবিরোধী, দুষ্কৃতকারী, মধ্যবিত্ত জার্মান ও বাম বিরোধীদের মধ্য থেকে। তাদের অনেক দাবি ও অভিযোগ, কেউ কেউ আন্দোলন করছেন টিভি ও পাবলিক রেডিওর লাইসেন্স ফির বিরুদ্ধে। কিন্তু মুসলিম ও অভিবাসন বিরোধী দাবি হলো তাদের কাছে দ্বিতীয় পর্যায়ের দাবি। ইয়ুরডাকুল বলেছেন, ‘যেভাবে আন্দোলনটি দানা বেঁধে উঠেছে এবং শেষে এসে এটি উদ্বাস্তুবিরোধী, তুর্কি ও মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।’
সমালোচকেরা গণমাধ্যমকে বলছেন, এই বিক্ষোভে যারা অংশ নিচ্ছে তারা ‘বিশ্বায়নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তারা জার্মানির অন্যান্য অংশের বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় কোনোক্রমেই সংযুক্ত নয়। ইয়ুরডাকুল আরো ব্যাখ্যা করে বলেছেন, জার্মানি অভিবাসীদের ব্যাপক সমাগমের ফলে গত ২০ বছরে দেশটি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে জার্মানিতে বেশি অভিবাসী আসছে। গত বছর জার্মানি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় দুই লাখ অভিবাসী বেশি নিয়েছে। বিগত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সময়ে অভিবাসীদের জার্মানিতে প্রবেশ করার শতকরা হার কম থাকার কারণে দেশটির পূর্ব অংশের মানুষের ‘অভিবাসী’ শব্দটির সাথে পরিচয় খুবই কম ছিল, যেটা এখন একটি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ভীতি এখন লোকগান ও স্লোগানে পরিণত হয়েছে, যাকে ইয়ুরডাকুল বর্ণনা করেছেন ‘হাস্যরসাত্মক বিষয়’ হিসেবে। অন্যরা বলছেন, তারা যেমন আগামী ১০০ বছরের মধ্যে তাদের মেয়েদের বোরকা পরা অবস্থায় দেখতে চায় না তেমনি তাদের রাস্তায় অনেক বেশি তুর্কি চলাচল করুক তাও কামনা করে না। এটিকে ইয়ুরডাকুল স্পষ্ট বর্ণবাদ, অযৌক্তিকতা ও অজ্ঞতা বলে অভিহিত করেছেন।
পেগিদা আন্দোলনকারীরা জার্মান সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম সত্য কথা বলে না’ এবং তারা সাধারণত গণমাধ্যমে কোনো সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করে। ইয়ুরডাকুল বলেছেন, ‘সব মানুষ চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তারা তাদের দাবি জানাতে পারে, কিন্তু তারা যেভাবে তাদের দাবিগুলো জানাচ্ছে ও যেসব শব্দ ব্যবহার করছে তা অগ্রহণযোগ্য। তারা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার জন্য দায়ী হিসেবে অন্য কাউকে চিহ্নিত করতে চাচ্ছে এবং এই শত্রু হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে তুর্কি, মুসলিম বা আশ্রয়প্রার্থীদের। এই সপ্তাহের বিক্ষোভকে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় হিসেবে বলা হচ্ছে। এতে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ সমবেত হয় (গত মাসে ছিল ১৭ হাজার)। কিন্তু এর বাইরে আরো অনেক বেশি সংখ্যায় জার্মান রয়েছে, যারা আন্দোলনে আসছে না এবং সমর্থনও করছে না। (গত রোববার এর বিরুদ্ধে ৩৫ হাজার লোক সমাবেশ করে ড্রেসডেনে)। জার্মানিতে এখনো অনেক সংগঠন এমনকি চার্চের প্রতিনিধিও অভিবাসী, আশ্রয়প্রার্থী ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে ঘৃণ্য বক্তব্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বলে ইয়ুরডাকুল উল্লেখ করেন।
গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ড্রেসডেন ও কলোগনিতে বর্ণবাদী সমাবেশের প্রতিবাদস্বরূপ গির্জাগুলো লাইট বন্ধ করে রাখে। ড্রেসডেন শহরের অপেরা হাউজ ও শহরে বর্ণবাদী সমাবেশের প্রতিবাদে লাইট বন্ধ করে রাখে। বার্লিনের পেগিদা মিছিলে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সংখ্যায় অনেক কম। সেখানে বর্ণবাদী মিছিলের প্রতিবাদে ব্রান্ডেনবার্গ গেটের লাইট বন্ধ রাখা হয়। এতেই প্রমাণিত হয় পেগিদা আন্দোলনের পেছনে জোরালো কোনো সমর্থন নেই।
সেখানে বেশ কিছু পাল্টা বিক্ষোভও হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের শহর মিউনিখে গত মাসে পেগিদা বিরোধী বিক্ষোভ হয় এবং সেটাতে ১২ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘জায়গা আছে, আশ্রয়প্রার্থীরা স্বাগতম’। জনসংখ্যাবিষয়ক তথ্যানুযায়ী জার্মানির জনসংখ্যা প্রবীণদের আধিক্য ও নি¤œ জন্মহারের কারণে দেশটি বড় ধরনের শ্রম ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে। মানুষ অবসরে যাচ্ছে এবং জার্মানি কর্মক্ষম মানুষের অভাব পূরণে আরো বেশি অভিবাসী গ্রহণ করতে চাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, কয়েক দশক ধরে জার্মানিতে অভিবাসীবিরোধী বর্ণবাদ জায়গা করে নিয়েছে। তারপরও এটা বলা খুব কঠিন নয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদে অগ্নিসংযোগ ও স্কার্ফ পরিহিত নারীদের ওপর হামলার জন্য এসব বর্ণবাদী মিছিল ও সমাবেশ দায়ী। ইয়ুরডাকুল আরো বলেন, ১৯৮৯ সালে দেয়াল ভেঙে ফেলার পর তুর্কিদের বাড়িগুলোতে ভয়াবহ হামলা হয়েছে ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জার্মানির চরমপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠন ন্যাশনাল সোস্যাল আন্ডারগ্রাউন্ডের একজন সদস্যকে ২০০০-২০০৬ সাল পর্যন্ত একের পর অভিবাসী হত্যার দায়ে এখন বিচার করা হচ্ছে। ইয়ুরডাকুল বলেন, ‘ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরের অনেক দেশেরই অংশ বর্ণবাদ এবং একই সাথে এটি জার্মান ইতিহাস ও জার্মান সমাজের অংশ। বর্তমানে এটি একটু বেশি মাত্রায় জার্মানিতে ঘটছে। যার উদাহরণ হলো মসজিদে আগুন দেয়া। অতীতেও বর্ণবাদী ঘটনা ঘটেছে, তবে তা হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে।’ সূত্র : হুররিয়াত ডেইলি