বিষাক্ত এই রাজনীতি কি দূর হবার নয়
সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবনযাপনে উপলব্ধি করে রাজনীতি তাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে রাজনীতি করে খান, আর সাধারণ মানুষ রাজনীতির ফল ভোগেন। রাজনীতি সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হলে মানুষের দুঃখ কমে, আর ভুল পথে পরিচালিত হলে মানুষের ভোগান্তির মাত্রা বাড়তে থাকে। দেশে রাজনীতির এখন যে চেহারা, তাতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ব্যাপারে জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরেও দেশের রাজনীতিবিদদের দিকে চেয়ে আছে দেশের জনগণ। কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনের সিদ্ধান্তাবলী তাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সেইসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন দেশের রাজনীতিবিদরাই। এখানে প্রশ্ন জাগে, দেশের জনগণ রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের যতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, রাজনীতিবিদরা কি জনগণকে ততটা গুরুত্ব দেয়ার দায়িত্ব পালন করছেন? এমন দায়িত্ব পালন করতে হলে তো ত্যাগ-তিতিক্ষা, আদর্শ-নিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের অনুশীলন প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হলো, এসব ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতিবিদরা বেশ পিছিয়ে আছেন। ফলে রাজনীতিবিদ ও জনগণের সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারছে না উন্নতি ও প্রগতির ঐকতান। বরং ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা করতে গিয়ে রাজনীতিতে ঘটে গেছে কলঙ্কের দুর্বৃত্তায়ন। ফলে দেশের রাজনীতিতে কর্মযজ্ঞের প্রতিযোগিতার বদলে এখন চলছে হিংসা-বিদ্বেষ ও নির্মূলের অভিযান। যে দেশের রাজনীতিতে এমন অভিযান চলে, সে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কিংবা উন্নয়নের রাজনীতি সম্ভব নয়। এমন বাস্তবতার মধ্যেই এখন আমাদের বসবাস। জনগণ এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির সেই প্রহর কখন কিভাবে আসবে আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক আলোচনা হয়, লেখালেখিও হয়। গত সোমবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর ‘বাংলাদেশ : পিন্ড ব্যাক বাই পলিটিক্স’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশী ও বিদেশী বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বিশ্বের অন্যতম গরীব ও সবচেয়ে জনবহুল দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের ক্ষেত্রে বৃহত্তম হুমকি রানা প্লাজার মত ভবন ধসের ঘটনা নয়, বরং বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষাক্ত রাজনীতি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় : “বাংলাদেশে সাধারণভাবে প্রচলিত একটি কথা হচ্ছে, এখানে বিজয়ীরাই সব পায়। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা তাদের প্রতিপক্ষের ওপর অবলীলায় নির্যাতন চালায়, মহাসমারোহে দুর্নীতি আর চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়। বর্তমান সরকার এসব প্রবলভাবে করার ফলে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। পরিণতিতে এখন অবাধ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তারা ভীত।” সরকারের এমন মানসিকতা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনও ছাপা হচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ক্ষমতায় থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা ভাবনাও করা হচ্ছে। নতুন সংশোধনীতে জাতীয় সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন দেয়ার বিধান রাখা হতে পারে। তাছাড়া সরকারের মেয়াদও নির্বাচন-পরবর্তী ৬ মাস রাখা হতে পারে। অথচ বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনের ৩ মাস আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সরকারের নীতি-নির্ধারকরা জানিয়েছেন, এখন যে কোনো উপায়ে নির্বাচন দিলেই তাদের পরাজয় হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সরকারকে যে তথ্য জানিয়েছে তাতে সরকারের জনপ্রিয়তার মারাত্মক ধসের চিত্র ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায় সরকার আর কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। বিরোধী দলের কঠোর আন্দোলনের মধ্যেও তারা তাদের অবস্থান থেকে সরতে চাইবে না। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা নির্বাচনে এলে সে নির্বাচন সরকারি দলের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। এ কারণে বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে আসার মত পরিবেশ না পায় তেমন ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সঙ্গত ও যৌক্তিক মনে করলেও সরকার সে পথে হাঁটছে না। ইতিহাসের সত্য হলো, রাজনীতিবিদরা যা ভাবেন সব সময় তা হয় না। অনেক কলাকৌশলই হিতে বিপরীত বলে প্রমাণিত হয়। দেশ তো কোনো ব্যক্তি বা দলের নয় বরং সব মানুষের। রাজনীতিবিদরাও একথা বলে থাকেন যে, জনগণের জন্যই তারা রাজনীতি করে থাকেন। এমন কথায় আস্থা থাকলে রাজনীতিবিদরা জনগণকে ভয় করবেন কেন? বরং মেয়াদ শেষে জনদরদী রাজনীতিবিদরা তো অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। আর বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। এখন যারা তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচন চান না, তারা আসলে গণরায়কে ভয় করেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জনগণের রায় চাইলে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করতে হয়। ক্ষমতায় গিয়ে সব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে নিজেদের পকেট পুরলে কোনো কৌশলই আর কাজে আসে না। এ কারণেই হয়তো গত ৫ আগস্ট দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন -এর প্রধান শিরোনাম হয়েছে ‘গণরোষ আতঙ্কে এমপিরা’। এই প্রতিবেদনে বলা হয় : মহাজোট সরকারের অনেক সংসদ সদস্য এবার ঈদে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন। দলের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, গত সাড়ে চার বছরে সাংগঠনিক কাজে অংশ না নেয়া, এলাকার উন্নয়ন না করাসহ অঙ্গীকার খেলাফের দায়ে তাদের গণরোষে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কঠিন এই পরিস্থিতি এড়াতে গত এক বছর ধরে অনেক মন্ত্রী-এমপিই এলাকায় যান না। ধারণা করা হচ্ছে, আতঙ্কের মুখে এবার ঈদেও অনেকে নির্বাচনী এলাকায় পা দেবেন না। জানা গেছে, মহাজোটের সংসদ সদস্যদের মূল সমস্যা নিজ দলে। কারণ জনবিচ্ছিন্ন এই নেতাদের ভালোভাবে নিচ্ছেন না কর্মীরা। অনেক সংসদ সদস্য ঈদের আগে- পরে নিজ এলাকায় লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। যশোর এলাকায় এক সংসদ সদস্যের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পিস্তল উঁচিয়ে বাঁচতে হয়েছিল এক সংসদ সদস্যকে। সূত্র মতে, পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি বরং অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা আগের চেয়ে আরও বেশি ক্ষুব্ধ। আর তাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষও চরম বিরক্ত। এমন অবস্থায় ক্ষমতার রাজনীতিতে বুঁদ না হয়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের আরও মৌলিক বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্য চিরস্থায়ী বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষের কর্মকা- ও ইমেজ। মানুষ চাইলে দল ক্ষমতায় যাবে, না চাইলে যাবে না, এটাই তো গণতন্ত্রের মূল কথা। তাহলে ক্ষমতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এতটা উতলা হবে কেন? আর গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী মানুষের জন্য কাজ করলে সরকারি দলের এমপিরা গণরোষ আতঙ্কে নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে ভয় পাবেন কেন? আমরা মনে করি, গণরোষ কমাবার এখনও উপায় আছে। হাতে যে কয়েক মাস আছে, এই দিনগুলোতেও যদি সরকারি দলের এমপি ও নেতা-কর্মীরা গণতন্ত্রসম্মত আচরণ করেন, নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং জনকল্যাণে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন তাহলে গণরোষ হ্রাস পেতে পারে। আর যারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আছেন তাদেরও উপলব্ধি করতে হবে যে, দিন বদলে দলীয় দাপটে দেশ পরিচালনার কারণে জনদুর্ভোগের মাত্রাও তারা বাড়িয়েছেন। এ কারণে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার কৌশল বাদ দিয়ে গণতন্ত্রসম্মত ব্যবস্থায় তাদের সম্মত হওয়া প্রয়োজন। নয়তো গণবিক্ষোভ ও গণরোষের মাত্রাই শুধু বাড়বে। ক্ষমতাসীন প্রাচীন এ দলটির এ বিষয়টি তো না জানার কথা নয় যে, জনমতের বিপক্ষে গিয়ে দমননীতির মাধ্যমে কখনও ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। সরকারকে আরও মনে রাখতে হবে যে, শেয়ার কেলেঙ্কারি, রেল কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক, ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, ইলিয়াস আলী গুম ও সাগর-রুনি হত্যাকা- দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। এসব বিষয় এখনও জনমনে জ্বল জ্বল করছে। আমরা চাইবো এতোসব ব্যর্থতার পর আমাদের সরকার যেন আর ব্যর্থতার পথে না হাঁটেন। বরং গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সরকার বিদায় নিলে ক্ষতির মাত্রা অনেক কমবে। আর রাজনীতিতে জয়-পরাজয় তো কোনো নতুন বিষয় নয়। ভুল থেকেই রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নিয়ে থাকেন। যারা ভুল থেকে শিক্ষা নেন তারাই আবার বিজয়ের পথে ফিরে আসতে পারেন। এমন গণতান্ত্রিক চেতনাই আমরা আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশা করি।