প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ সা:
মোজাফফর হোসেন: ‘পড়ো তোমার সেই প্রভুর নামে, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।’ বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও আলোকিত এই বাণী শুধু মুহাম্মদ সা:-কে বা মুসলিমদের উদ্দেশ করে বলা হয়নি, বলা হয়েছে পৃথিবীর সব মানুষকে লক্ষ্য করে। কিন্তু এই চিরসুন্দর ও সত্যবাণীটি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম থেকে কৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার অজুহাতে। অথচ আল্লাহ ঘোষণা করেছেন ‘তোমরা আমার কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? আর যদি অস্বীকারই করবে তাহলে আমার পৃথিবী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও। যে দিকেই যাও সে দিকেই আল্লাহর জমিন বিস্তৃত।’ এই অকাট্য সত্য বক্তব্যগুলো যার মাধ্যমে মানুষদের শুনানো হয়েছে, তিনিই হলেন জগতের শ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ সা:। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজ তেমন একটা গুরুত্বের দাবি রাখে না। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশ ও বাস্তবতা সেই সত্যটিই প্রমাণ করে চলেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান কারিকুলাম অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে প্রবন্ধ রচনার জন্য ২০ নম্বরের একটি প্রশ্ন রাখা হয়। যে প্রশ্নে মাঝে মধ্যেই বলা হয়, তোমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব বিষয়ে একটি নিবন্ধ রচনা করো। এই প্রশ্নের উত্তর করতে গিয়ে বেশির ভাগ মুসলিম শিক্ষার্থী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা নিজেদের বাবা-মা কিংবা অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিক অথবা আরো অন্য কোনো গুণী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে নিবন্ধ রচনা করে থাকেন। এটাকে দোষের কিছু বলা যায় না বা এটা করা সাম্প্রদায়িকতাও নয়। তবে হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর চরিত্রকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবলোকন করাও কোনো সাম্প্রদায়িকতা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা বিষয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী যতটা গুরুত্বসহকারে অন্যসব ব্যক্তিত্বকে স্টাডি করতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান করে থাকেন, সেসব ব্যক্তিত্বের তুলনায় হজরত মুহাম্মদ সা:-কে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেয়া হয় বলে অনেকে সন্দেহাতীত ধারণা পোষণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই সত্যটি অনায়াসে ধরা পড়ে যায় বিচক্ষণতার সাথে। দেখা যায়, খুব সামান্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে ঘিরে নিবন্ধ রচনা করেছেন। কেন হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর মতো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন ব্যক্তিত্ব স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেননি, কেনই বা প্রিয় ব্যক্তিত্ব বলতে মুহাম্মাদ সা: ব্যতীত অন্য কারো নাম শিক্ষার্থীদের মনের কোনায় ভেসে ওঠে, তার পেছনেও হয়তো একটি কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। কারণটি হলো, আমরা যদি কয়েক দশক আগে থেকে দেখি, তাহলে দেখব, এ দেশের স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় বাংলা বিষয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি; যাদেরকে একসময় বাংলা বিষয়ে পণ্ডিতও বলা হতো। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় দেখা যায়, প্রিয় ব্যক্তিত্ব না বলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক হয়তো বলেন, তোমার প্রিয় কবি বা সাহিত্যিক বিষয়ে নিবন্ধ রচনা করো। তোমার প্রিয় কবি বা সাহিত্যিক যদি বলা হয় তাহলে মুহাম্মদ সা: এমনিতেই বাদ পড়ে যান, কারণ মুহাম্মদ সা: কোনো কবি বা সাহিত্যিক নন। এতে কাসে মুহাম্মাদ সা:-কে পড়ানো হলেও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় শিক্ষার্থীরা কবি-সাহিত্যিকদেরকেই অত্যধিক গুরুত্বসহকারে পড়ে থাকেন। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবারই আইকন হওয়া উচিত ছিল হজরত মুহাম্মাদ সা:। হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে একমাত্র আদর্শ ব্যক্তিত্ব ধরে নিলে আদর্শ খোঁজার জন্য আর অন্য কোথাও দৌড়াতে হয় না বলেই পৃথিবীর বহু প্রখ্যাত প্রথিতযশা ব্যক্তি তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মুহাম্মাদ সা: যে অনুকরণীয় আইকন, সে সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে উৎকৃষ্টতম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আহজাব : ২১)। আল্লাহ পাক আরো বলেন ‘হে নবী! আমরা আপনাকে সাক্ষ্য ও সুসংবাদদাতা, ভীতিপ্রদর্শনকারী এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর দিকে আহ্বানকারী রূপে এবং একটি উজ্জ্বল আলোকশিখা হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আহজাব : ৪৫-৪৬)। এই মহামানবের চারিত্রিক সার্টিফিকেট প্রদান করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন ‘আর নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ (সূরা কালাম : ৪)। হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর চরিত্রের এমন কোনো দিক নেই যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে খাটো করে দেখা যেতে পারে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, সেনাপতি হিসেবে, বিচারক হিসেবে, একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে, আমানতদার হিসেবে, পথপ্রদর্শক হিসেবে, মানবাধিকারের প্রবর্তক হিসেবে, দয়াদ্র প্রতিবেশী হিসেবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর আদর্শ শ্রেষ্ঠ আদর্শ। অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ কাঠামোতে রাসূলের আদর্শ ছিল অনন্য। শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। দাসপ্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। আধুনিক সমাজে নারীর মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলা হয়। আমরা ভুলে যাই, পনেরো শ’ বছর আগেই হজরত মুহাম্মাদ সা: নারীদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিতে গিয়ে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজো নারীর সম্মানের বিষয়ে মুহাম্মাদ সা:-এর চরিত্রের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শে বিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের পিতামাতাকে বৃদ্ধ বয়সে অসহায়ত্ব নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। যে চরিত্রের অনুকূলে এলে এতিমকে তার সম্পদ হারানোর ভয়ে শঙ্কিত থাকতে হয় না। এমন এক ব্যক্তিত্বকে আমরা প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্কুল-কলেজে পড়াতে পারি না। পারি না বলেই হয়তো সমাজের নৈতিক অধঃপতন একটু বেশিই চোখে পড়ে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজকের যেকোনো স্কুল-কলেজে পড়া ছেলে-মেয়েকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে? উত্তর দিতে গিয়ে সে হয়তো বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম বলবে কিংবা বাংলাদেশের কোনো কণ্ঠশিল্পীর নাম বলবে। অথবা বলবে, হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। হতাশার কথা হচ্ছে, যাকে আইকন ভাবার কথা, তাকে বাদ দিয়ে আমরা আইকন হিসেবে বেছে নিয়েছি যাদের চরিত্র বলতে কিছু নেই তাদেরকে। মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য এখানেই। একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের শিক্ষা কমিশন হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে মূল্যায়ন করতে উদাসীন হলেও একজন মার্কিন জোতির্বিজ্ঞানী তার মূল্যায়ন যথার্থই করেছেন।
এই মার্কিন জোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হান্ড্রেড এ র্যাঙ্কিং অব দি মোস্ট ইনফুয়েনশিয়াল পারসন ইন হিস্টোরি’ গ্রন্থে হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে তার ওই গ্রন্থে সর্বপ্রথমে মুহাম্মাদ সা:-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী সংযোজন করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুহাম্মাদ সা: তাঁর ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছেন, অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবের; কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো পার্থক্য নেই। তিনি সুদকে নিষিদ্ধ করে জাকাত-ভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন, যেখানে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছে। মুহাম্মাদ সা: ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিক খ্রিষ্টান লেখক উইলিয়াম মুর লিখেনÑ ‘মুহাম্মাদ সা: যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁকে শুধু সেই যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।’ শ্রেষ্ঠ মানুষের মডেল মুহাম্মাদ সা: এবং শ্রেষ্ঠ মুসলিমেরও মডেল হজরত মুহাম্মাদ সা:। এই অকৃত্রিম মানুষটিই যত দিন না হয়ে উঠবে পৃথিবীর সব মানুষের জীবন পরিচালনার আদর্শ আইকন, প্রিয় ব্যক্তিত্ব; তত দিন পৃথিবীতে শান্তির বাতাস আশা করা এবং আমাদের নৈতিক উন্নয়ন মজবুত করা কঠিন হবে বলেই অনেকে বিশ্বাস করেন। -লেখক : গবেষক