বাংলাদেশের রাজনীতি : সহিংসতার গন্তব্য কেউ জানে না
নব্বই-পরবর্তী সব রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এখনকার নাশকতা ও নৃশংসতা। অন্যান্য সময় নির্বাচন হওয়া বা সরকার পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে, কিন্তু এখন তেমন কোনো গন্তব্য না থাকায় দেশ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে কবে, কীভাবে বের হওয়া যাবে, তা নিয়ে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বা দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও কিছু বলতে পারছেন না। শুধু কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার কথা বলা হলেও পরিস্থিতি দিন দিন বেসামাল হয়ে পড়ছে। আর পরিস্থিতির শিকার হয়ে জানমাল হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এ প্রসঙ্গে একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপের কোনো চিন্তাই করছে না সরকার। বরং প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও আইনশৃঙ্খলা কতটা জোরদার করা যায়, সেই আয়োজন চলছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনও করতে দেওয়া হবে না। গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, খালেদা জিয়া কোনো কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলে সেখানেই বসে পড়তে পারেন। তিনি বসে গেলে নেতা-কর্মীরা ঘরে বসে থাকতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থেকেই খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে।
১১ ও ১৮ জানুয়ারির ইজতেমা শেষে এমন আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত থাকলেও তেমন কিছুই ঘটেনি। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, এর আগে বিএনপির মূল্যায়ন ছিল, রাজধানীতে আন্দোলন জমাতে না পারায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন হলেও তার ফল দলটি পায়নি। এক বছর ধরে বিএনপি রাজধানীতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ঢাকার প্রতি মনোযোগ বাড়িয়েছে।
সরকারদলীয় একাধিক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা জানান, আলোচনা বা সংলাপের কোনো ভাবনাই সরকারের মধ্যে নেই। বরং কঠোরভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উপায় খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি দলীয় সভা-সমাবেশ করে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করছে।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে বিরোধীদলীয় নেতা আলোচনায় অংশ নিলে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি না-ও হতে পারত। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী সংলাপের চেয়ে রাজনৈতিক কর্ম-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কিন্তু লন্ডন থেকে পাঠানো শব্দবোমা, আন্দোলনের নামে নাশকতা ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে দুই পক্ষই এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, এখনকার সহিংস ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সিভিল সোসাইটিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে, তাদের উচ্চ স্বরে কথা বলতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুই দলের মধ্যে দূরত্ব জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। আগে পাঁচ বছর পর পর সংকট হতো, এখন বছরে বছরে তা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আইনমন্ত্রীর বাড়িতে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমাবেশে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে, হাইকোর্ট চত্বরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ওপর বিক্ষিপ্ত হামলার ঘটনাগুলো জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের সাংসদ ছবি বিশ্বাস আক্রান্ত হয়েছেন। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন, আইনশৃঙ্খলা কর্মীদের সশস্ত্র পাহারায় সরকারি নেতাদের চলাফেরার ঘটনাগুলো নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়েছে।
এর পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা ও নৃশংস ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক বাড়িয়েছে। পুলিশ-বিজিবি পাহারায়ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার দৃষ্টান্ত মিঠাপুকুরে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় পাঁচজন নিহত ও ১১ জন দগ্ধ হওয়ার ঘটনা।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর গুলির ঘটনায় সরকার ও বিরোধী রাজনীতিকেরাও আতঙ্কের মধ্যে আছেন। বিএনপির সামনের সারির নেতা না হলেও তাঁর এমন পরিণতিতে সরকারি দলের নেতারাও অস্বস্তিতে পড়েছেন। এর আগেও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা, আরেক উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর গুলশান অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া, উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনের রামপুরার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার চেম্বারের সামনে ককটেলের বিস্ফোরণ, স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে ফাঁকা গুলি ও খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাসার সামনে গুলি ছোড়া হয়। একাধিক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনে নেতা-নেত্রীদের তির্যক বক্তব্য, জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংস ঘটনাগুলো চলমান অস্থিরতা উসকে দিচ্ছে।
বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ফোন করার মিথ্যা ঘটনা এবং মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্যের ভুয়া বিবৃতি বেকায়দায় ফেলেছে বিএনপিকে। এদিকে খালেদা জিয়া চাইলে দলীয় কার্যালয় ছেড়ে বাসায় যেতে পারেন-সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ কথা বলা হলেও ১৭ দিন ধরে ‘অবরুদ্ধ’ থাকা, বিএনপির কার্যালয়ের সামনে বালুর ট্রাক রাখা এবং কার্যালয়ের ফটকে তালা দেওয়ার বিষয়গুলো রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আর বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দিয়ে ১২ জানুয়ারি সরকারি দলের সমাবেশ করা এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা ও দলীয় সমাবেশে এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য নেতাদের মুখে তা প্রচার করার বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে সমালোচনা আছে।
এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, যাঁরা মনে করছেন সভা-সমাবেশ করার অধিকার দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তাঁরা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার নাশকতার প্রস্তুতি ঠেকানো এবং অন্তর্ঘাতমূলক কাজ রুখে দেওয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের। আন্দোলনের নামে যিনি নাশকতা করছেন, মানুষ হত্যা করছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তাঁর সঙ্গে কিসের সংলাপ? সরকার ও বিরোধীদের এই অনড় অবস্থানের মধ্যে একের পর এক সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সম্পদ। কিন্তু এ পরিস্থিতি আর কত দিন চলবে, সেই জবাব কারও কাছে নেই।
এ পরিস্থিতি কোথায়, কীভাবে শেষ হবে, তা সম্পর্কে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এর শেষ হচ্ছে এক পক্ষকে হারতেই হবে। খালেদা জিয়াই সেই পক্ষ। গণতন্ত্রের গেট পাস তিনি পাবেন না। একাত্তর ও নব্বইয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি হেরেছে, এবারও তাই হবে।’
আর এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনীতিতে চিরশত্রুতা থাকে না। তবে এ পরিস্থিতি কবে, কীভাবে শেষ হবে, তা সময়ই বলে দেবে। মন্ত্রিসভায় থাকা ভিন্ন দলের একজন প্রবীণ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা তো এভাবেই এত দূর এসেছি। স্বাধীনতার পর থেকে কিছুদিন পর পর এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল। তবে এবারের সংকটটা বেশ গভীর এবং অস্তিত্বের সংকট। তাই সমাধানের সহজ পথ নেই।’
আর মাহবুবুর রহমান বললেন, ‘রাজনীতির আকাশে শুধু মেঘই দেখছি। তার পরও ভরসা হচ্ছে, সব সংকটে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। এবারও হয়তোবা হবে।’