বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বেড়ে গেছে
চলতি মাসে ‘ক্রসফায়ার’ বেড়ে গেছে বাংলাদেশে। ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধে এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন সাতজন। এদের মধ্যে অন্তত চারজন বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। খবর ডিডব্লিউ’র।
বাকিদের মধ্যে দু’জনের পরিচয় এখনও মেলেনি আর অপরজনকে ডাকাত সর্দার বলে দাবি করছে পুলিশ।
মানবাধিকার নেতা নূর খান জানিয়েছেন, ১ জানুয়ারি থেকে ক্রসফায়ারে মোট নয়জন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া সর্বশেষ বুধবার ভোর রাতে রাজশাহী এবং সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ দু’জন নিহত হয়েছেন।
রাজশাহীতে নিহত হয়েছেন জামায়াত কর্মী নুরুল ইসলাম শাহীন (৫০)। তিনি রাজশাহীর বিনোদপুর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক। বুধবার ভোরে নগরীর নলখোলা আশরাফের মোড় থেকে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত নুরুল ইসলাম শাহীনের স্ত্রী মাসুমা আখতার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আমার স্বামীকে নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার পদ্মা অফসেট প্রেস থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ আটক করে। আমরা প্রথমে বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়েও আটকের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারিনি। পরে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে গেলে সেখানে নুরুল ইসলাম শাহীনকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা হয় যে, বুধবার তাকে আদালতে নেয়া হবে।
মাসুমা আখতার দাবি করেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটকের পর শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
তবে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, মঙ্গলবার রাতে জামায়াত কর্মী নুরুল ইসলাম শাহীনকে আটকের পর তাকে সাথে নিয়ে নলখোলা এলাকায় অভিযানে যায় পুলিশ। সেখানে পৌঁছালে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা জামায়াত-শিবির কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পালাতে গিয়ে নুরুল ইসলাম শাহীন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরে সেখান থেকে ককটেল, গুলি ও রিভলভার উদ্ধার করা হয়।
তার দাবি, নুরুল ইসলাম শাহীন জামায়াত-শিবিরের অস্ত্রধারী ক্যাডার।
অন্যদিকে বুধবার ভোরে সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন আরো একজন। নিহত ব্যক্তির নাম রফিকুল ইসলাম (৩৮)। মঙ্গলবার বিকালে নওয়াকাটি থেকে পুলিশ তাকে আটক করে।
পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, মঙ্গলবার বিকালে আটকের পর রাতে রফিকুলকে নিয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। ওবায়তলা নামক স্থানে অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে রফিকুলের সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং পুলিশের ওপর গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হয় রফিকুল। আহত অবস্থায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া নিহত রফিকুলের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা আছে বলেও জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
এর আগে রবিবার ভোরে ঢাকার রামপুরা এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবক নিহত হন। র্যাব দাবি করেছে তারা ‘দুষ্কৃতকারী’।
জানিয়েছে, রবিবার ভোর রাত পৌনে ৩টার দিকে রামপুরায় র্যাবের একটি চেকপোস্টে একটি প্রাইভেটকারকে থামার সংকেত দেয়া হয়। তখন ওই গাড়ি থেকে তিন যুবক নেমে র্যাব সদস্যদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। পরে গুলিতে আহত দু’জনকে ভোর ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনি ও ২০ জানুয়ারি খিলগাঁওয়ের জোড়াপুকুর খেলার মাঠের পাশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ তিনজন নিহত হন। নিহত এই তিনজন বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বিএনপির চেয়ারাপারসনের উপদেষ্টা এডভোকেট আহমেদ আযম খান ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, সরকার বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের অবরোধ ও আন্দোলন দমাতে ক্রসয়ারের নামে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। তারা ভীতি ছড়াতেই এই হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। আর তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে।
তিনি বলেন, এগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকান্ড।
আহমেদ আজম খান দাবি করেন, হামলা, মামলা, ক্রসফায়ার সবকিছুই করা হচ্ছে ক্ষমতা ধরে রাখতে। সরকারের লোকজনই নাশকতা করছে। আবার তারাই এই নাশকতার দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে ক্রসফায়ারে নামছে।
মানবাধিকার নেতা নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ১ জানুয়ারি থেকে এহেন ক্রসফায়ারে ৯ জন নিহত হয়েছেন। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কৌশল। তা হল, গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা।
তবে তার মতে, সরকারের এই কৌশল কোনো কাজে আসবে না। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাবে।
ক্রসফায়ারকে তিনি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে বলেন, চলতি মাসে ক্রসফায়ার বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরকার ও বিরোধীদের অবরোধ কর্মসূচির একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু নাশকতা বন্ধের নামে ক্রসফায়ার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বন্ধ করতে হবে।
নূর খান বলেন, অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া সরকারের দায়িত্ব। তাছাড়া বিনা বিচারে বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড একটি জঘন্যতম অপরাধ।
ওদিকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে প্রয়োজনে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার পুলিশ সপ্তাহ ২০১৫ উপলক্ষ্যে তেজগাঁওয়ে নিজ কার্যালয়ে পুলিশের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, ‘পেট্রোল দিয়ে মানুষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যখন যেখানে যে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, তা নিতে সরকারপ্রধান হিসেবে আমি আপনাদের স্বাধীনতা দিচ্ছি।
শুধু তাই নয়, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা দমনে কর্মকর্তাদের দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।