ভাগ্য অন্বেষণে নিজ দেশ ছাড়ছেন মিসরীয়রা

Egyptনিজ দেশে ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে মিসরের হতাশ তরুণরা কাজের সন্ধানে ছুটছেন লিবিয়া অভিমুখে। যদিও লিবিয়া বর্তমানে নিজেই একটি অরাজক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেখানকার বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং অহরহ তাদের নিজেদের জনগণকেই অপহরণ করছে। এমন এক খারাপ অবস্থাতেও মিসরীয়রা নিজ দেশ ছাড়ছেন তাদের ভাগ্য অন্বেষণে।
মিসরে দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার অর্ধেকই ২৫ বছরের নিচে। ফলে প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির জন্য মিসরের বেকারত্ব মোকাবেলা করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত চার বছরে দেশটিতে দু’জন প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করা হয়েছে। ২০১১ হোসনি মোবারকের পতনের অন্যতম কারণ ছিল এ বেকারত্ব। বেকারত্বের কারণে তখন হাজার হাজার তরুণ ক্রোধে বিদ্রোহে অংশ নেয়। সিসির আমলেও বাসস্থান ও সংসার পরিচালনার ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হওয়ার কারণে এখনও অনেক যুবক দাম্পত্য জীবন শুরু করতে অক্ষম হচ্ছে। মোবারকের পতনের পর থেকে চলা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পর্যটকেরা মিসর থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মিসর আরব বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশটিতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি।
এই অধিক জনসংখ্যা দেশটির চাকুরির সঙ্কটকে আরো তীব্রতর করে তুলেছে। বর্তমানে সেখানে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ, যা মোবারকের সময় ছিল ৮.৯ শতাংশ। লিবিয়া এ অঞ্চলের অন্যতম একটি বিপজ্জনক দেশ হওয়ায় মিসর সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও ২০১১ সাল থেকে হাজার হাজার মিসরীয় কাজের সন্ধানে ছুটে চলেছেন প্রতিবেশী দেশটিতে।
লিবিয়া জুড়ে তাদের বিভিন্ন নির্মাণ সাইটে, কারখানায়, রেস্টুরেন্ট এবং শহরগুলোর বিভিন্ন দোকানে কাজ করতে দেখা যায়। কায়রো থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২৫ মাইল) দক্ষিণে আল-আওয়ার গ্রামে গেলে বুঝা যায় কেন অল্প বয়স্ক এই তরুণেরা ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলেছে লিবিয়া অভিমুখে। সেখানে কোনো পাকা রাস্তা নেই, নেই কোনো বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা কিংবা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যযতেœর ব্যবস্থা। অতীতে এ ধরনের অবস্থা অনেক যুবককে নিজ দেশ ত্যাগ করে জঙ্গি গ্রুপের সাথে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বেকার এই মানুষগুলো দুর্গন্ধে ভরা, আবদ্ধ পানির খালের পাশে বসে থাকে।
স্যামুয়েল আলহাম তার স্ত্রী ও তার তিন সন্তান, তার তিন ভাইবোন ও তাদের সন্তান এবং তার বৃদ্ধ বাবা-মা’র সঙ্গে একটি ছোট আধাপাকা বাড়িতে বসবাস করেন। অনেক তরুণ মিসরীয়দের মত তিনিও স্বপ্ন দেখেন, ছোট এক টুকরো জমি ক্রয় করে সেখানে তিনি নিজের একটা বাড়ি তৈরি করবেন।
৩০ বছর বয়সী স্যামুয়েল আলহাম বড় অংকের টাকা ব্যয় করে প্লাম্বার শ্রমিক হিসেবে লিবিয়া যান। ডিসেম্বর মাসে লিবিয়া থেকে মিসরে ফিরে আসার পথে তিনি অপহৃত হন।
আলহামের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই। তিনি তার সন্তানদের ভরণপোষনের তাগিদে সেখানে গিয়েছিল। তিনি অন্যায় কোনো কিছু করেনি।’ আলহাম ছিলেন ২৭ মিসরীয়দের মধ্যে একজন। সেখানে তারা সামান্য বেতন পেতেন। আলহামসহ ওই ২৭ মিসরীয় ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে লিবিয়া থেকে অপহৃত হয়।
তাদের খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস হয়ত তাদের আরো বেশি ঝুঁকির মধ্য ফেলেছে। জঙ্গি গ্রুপ আইএসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ‘ক্রুসেডার’ অপহরণের জন্য দায়ী। আল-আওয়ার গ্রামটি মিনিয়া প্রদেশে অবস্থিত। এটি ঐতিহ্যগতভাবেই মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি দূর্গ হিসেবে পরিচিত। সিসি সেনা প্রধান থাকাকালীন অবস্থায় ২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। কয়েক দশকের অবহেলার পর মিনিয়া এবং দক্ষিণ মিসরের অন্যান্য অংশে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকেই মিনিয়া প্রদেশটি জঙ্গিবাদের একটি উর্বরভূমি।
মিনিয়ার আরেক বাসিন্দা আবানব আইয়াদ। তিনি তার সামান্য আয়ের কিছু সঞ্চয় করেন একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করার উদ্দেশ্যে যাতে তিনি একটি বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু এই সামান্য আয় দিয়ে এটি সম্ভব নয় ভেবে তিনি তার ভাগ্য বদলের চেষ্টায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে লিবিয়া গমন করেন। আইয়াদ তার ভাই ও বোনের কলেজে লেখা-পড়ার খরচের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই চলতি মাসে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। লিবিয়ার শহর সিরত হতে জঙ্গিরা তাকেসহ আরো ১২ জন মিসরীয় শ্রমিককে অপহরণ করে। আইয়াদের মা আজিজা ইউমান বলেন, ‘এখানে তেমন কোনো কাজ নেই যা দিয়ে তাদের সাহায্য করতে পারে।
মানুষ কিভাবে খরচ করবে, কিভাবে খাবে, কিভাবে লেখা-পড়া করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার তাদের কোনো রকম সহায়তা কিংবা তাদের সাথে যথাযথ আচরণ করছে না। এই অবস্থায় তারা কি করতে পারে?’
গত সপ্তাহে দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে সিসি বলেন, মিসরের লক্ষ্য ২০২০ সালের মধ্য বেকারত্ব ১০ শতাংশ কমিয়ে আনা। কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে তিনি দ্বিতীয় সুয়েজ খাল এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নির্মাণ কাজের প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তার এই প্রতিশ্রুতি আল-আওয়ারের মত গ্রামগুলোতে এখনো আশার আলো দেখাতে পারেনি। বুশরা শেহেতার ছেলে নয় বছর আগে স্নাতক পাস করেছে। কিন্তু তার ছেলে এখনো কোনো চাকরী পায়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলের জন্য একটি কাজ পেতে সরকারি কিংবা বেসরকারি উভয় খাতেই সব ধরণের প্রচেষ্টাই চালিয়েছি। কিন্তু সবই নিরর্থক হয়েছে।’ মিসরীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত একটি অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে তিনি আরো বলেন, ‘একটি কাজ পেতে প্রয়োজন ব্যাপক লবিং। লবিং ছাড়া কোনো কাজ জোটে না।’ গত সপ্তাহে অপহরণের শিকার হওয়া ২৭ শ্রমিকের প্রায় শতাধিক আত্মীয়-স্বজন কায়রোতে জাতিসংঘের অফিসের বাইরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। তারা তাদের প্রিয় মানুষদের ছবি হাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, তাদের মুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে। সেখানে আশাহত এক পিতাকে তার এক পুত্র এবং তিন নাতি সম্পর্কে তথ্যের জন্য বিলাপ করতে দেখা যায়। মিসরীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তারা তাদের মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই অবস্থা সত্ত্বেও শহরে জুড়ে হাজার হাজার মিসরীয় লিবিয়ান এয়ার লাইনস অফিসের সামনে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে আছে লিবিয় বিমানের টিকেট ক্রয় করতে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button