রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বর্তমান বাংলাদেশ

Cartonমোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন: মাসাধিকাল ধরে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দিনাতিপাত করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে প্রথম ১৬ দিন ছিলেন বালু বোঝাই ও ইট বোঝাই ট্রাক এবং পুলিশি ব্যারিকেডে অবরুদ্ধ। তারপর পুলিশি ব্যারিকেড তুলে নেওয়া হলেও অবরোধ ও কৌশলগত কারণে কার্যালয় ছাড়েননি তিনি। এরই মধ্যে তার জীবনের কষ্টদায়ক দুঃসংবাদটি নিয়ে আসেন নিকটাত্মীয়রা। অকালে মৃত্যুবরণ করেন তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে যোগ হলো পুত্রশোক। পুত্রশোকে যখন কাতর ও বিপর্যস্ত খালেদা জিয়া, তখন তার রাজনৈতিক কার্যালয়ের অতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ডিশ, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। প্রায় ২০ ঘন্টা পর অবশ্য বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা হয় কিন্তু অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ দিতে গড়িমসি করে সরকার। এসব খারাপ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে যোগ হলো।
কার্যত একজন সাধারণ মানুষের অতি প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ বন্ধ করতে হলেও আগে থেকে অবগত করতে হয় কিন্তু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অতি প্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ করা হয়েছে তাকে অবগত না করেই। যারা এটা করেছেন, তারা যে কতটা অসহিষ্ণু ও বিবেকবিবর্জিত; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্র চালানো তো দূরের কথা, একটা ছোট-খাটো প্রতিষ্ঠান চালানোর যোগ্যতাও তারা রাখেন বলে মানুষ মনে করে না। মানুষ আরও মানুষ মনে করে, এসব অপরাজনীতি আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূর না করলে; বাংলাদেশের ভবিষ্যত বলতে কিছু থাববে না।
অন্যদিকে পুত্রশোকের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক দেওয়া হচ্ছে গাড়ি পোড়ানোর হুকুমের আসামির মামলা। যেকোনো সময় গ্রেফতারের ঝুঁকিও রয়েছে তার। এর মধ্যেই তিনি অত্যান্ত দৃঢ়তার সহিত চালিয়ে যাচ্ছেন রাজনৈতিক কর্মকা-। যত ঝুঁকিই থাকুক, তার হয়তো আত্মবিশ্বাস আছে; চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনিই জয়ী হবেন। কার্যত খালেদা জিয়ার ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা ও তার জনপ্রিয়তার ওপরই বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তারা আরও মনে করেন; খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়-এমন কাজ ক্ষমতাসীন দল করবে না। দেশের ভালো চাইলে সমঝোতা করেই রাজনীতি করতে হবে এবং দেশ চালাতে হবে। এককভাবে রাজনীতি করে দেশ চালানো যে অসম্ভব-বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হচ্ছে। কাজেই সবাইকে অহমিকা, গোয়ার্তুমি ও অসহিষ্ণু মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে, রাজনীতিতে সহিষ্ণু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে; বিভেদ-বিভাজন তৈরি হয় বা রাজনৈতিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়-এমন বাক্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
দৃশ্যত আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুটি খুবই বেদনাদায়ক ও অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা। তার এই অকাল মৃত্যুতে দেশের মানুষ নির্বাক হয়ে যায়। শোকের ছায়া নেমে আসে সব জায়গায়। এর প্রতিফলনও ঘটে মরহুমের জানাযায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষের উপস্থিতির মাধ্যমে। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীসহ হাজারো মানুষ ছুটে যায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে। এমনকি ছুটে যান প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু গেইট খোলা না-পেয়ে কার্যালয়ে প্রবেশ না-করেই তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। এটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেয়নি। এমনকি বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতাও প্রধানমন্ত্রীর ফিরে আসাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন, যা বিএনপির রাজনীতির জন্য তাৎক্ষণিক হলেও বেকায়দার সৃষ্টি করে। আমিও ঘটনাটির গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। কেননা, এটি একটি বড় ধরনের ঘটনা। কারণ তিনি প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ ও ভাবমর্যাদা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
কিন্তু বিএনপির গুলশান কার্যালয় ঘটনাটিকে দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক ফিরে যাবেন এটি তারা কল্পনাও করতে পারেননি। তারা কার্যালয়ের ভেতরে বসে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করছেন এবং ভাবছেন-প্রধানমন্ত্রী আসার আগে তাদেরকে জানিয়ে এসএসএফ আসবে, তারা কার্যালয়ের দায়িত্ব নেবে, কার্যালয়ের ভেতরে ভীড় করা শত শত নেতামর্কীকে বেড় করে প্রধানমন্ত্রীর ভেতরে প্রবেশের রাস্তা ও তার নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করবে। তারপরই না প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার কিছুই হয়নি বলে কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এসে কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ফিরে যান। প্রধানমন্ত্রীর সেখান থেকে ফিরে আসার দৃশ্যটি আমরা টিভি চ্যানেলেও লাইভ দেখেছি। এটি দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে। আমি অনুমান করেছি, এখানে ভুল বোঝাবুঝির কিছু একটা ঘটনা হয়তো ঘটেছে; নয়তো প্রধানমন্ত্রী কষ্ট স্বীকার করে আসলেনই যখন, তখন প্রক্রিয়া শেষ না করে ফিরে যাবেন কেন। প্রধানমন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার ঘটনাটি অত্যান্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা-এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, যা ক্ষত-বিক্ষত রাজনৈতিক অঙ্গনকে আরও ক্ষত-বিক্ষত করবে। ঘটনাটি এড়ানো যেত যদি উভয় পক্ষ দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রটোকল যথাযথভাবে অনুসরণ করা হতো।
প্রধানমন্ত্রীর আগমনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়াপারসনের গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারীকে কার্যালয়ের অন্যান্য ব্যক্তিরা অবগত করেন; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করা হয়েছিল, এর কিছুক্ষণ পর বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারীকেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করা হয় এবং জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী শোক ও সমবেদনা জানাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আসছেন। উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যালয়ে উপস্থিত বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের পরামর্শ মোতাবেক চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের জানান যে, পুত্রশোকে বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন; বেগম জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তার ঘুম ভাঙলে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হবে। এর পর একটি সুবিধাজনক সময়ে সাক্ষাতের বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেছেন এবং এসএসএফ, পিজিআর ও পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অবস্থান নিয়েছে বিএনপি চেয়াপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে। এখানে নিরাপত্তা প্রটোকল যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কি-না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল।
আমরা জানি প্রধানমন্ত্রীর আগমন যেখানে ঘটে, সেটা কোনো অফিস হোক, বাড়ি হোক, হোক কোনো জনসভাস্থল-সেখানে কয়েক স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা (এসএসএফ) সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এসএসএফ প্রধানমন্ত্রীর আগমনের অন্তত কয়েক ঘন্টা আগে ভেন্যুর দায়িত্ব হাতে নিয়ে নেয় এবং ভেন্যুর নিরাপত্তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পর সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘটে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা সেটি দেখিনি, এটি হলে হয়তো সবাই অ্যালার্ট থাকত এবং এসএসএফ ক্লিয়ারেন্স না দেওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা করতে পারতেন আর ক্লিয়ারেন্স না দিলে প্রধানমন্ত্রী না আসার সিদ্ধান্তটিও নিতে পারতেন। তাহলে হয়তো এমন দুঃজনক ঘটনাটি নাও ঘটতে পারত। এখন জাতির জন্য এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে সম্মান জানিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাধ জানানো হয়েছে এবং ফিরে যাওয়ায় দুঃখও প্রকাশ করা হয়েছে।
লক্ষণীয় গত ২০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে, সেটি নিয়ে এখন মোটাদাগের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দুটি রাজনৈতিক শক্তি যে পথে এগুচ্ছে, তাতে বিগত দিনের অর্জিত সাফল্য ধরে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। দুটি রাজনৈতিক শক্তিই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বল প্রয়োগের বিপজ্জনক কৌশল গ্রহণ করেছে। এই বিপজ্জনক কৌশলে রাষ্ট্রের রক্তক্ষরণ হচ্ছে, রাষ্ট্র থরথর করে কাঁপছে; চূড়ান্তভাবে তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই এখনও সময় আছে পরিস্থিতি অনুধাবন করার এবং দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার। এখানে উভয় রাজনৈতিক শক্তিকেই দেশের কথা ভেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বিশেষ করে যারা ড্রাইভিং সিটে থাকেন, তাদের দায়িত্বটাই এখানে মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button