কেমুসাসে কর্তৃত্বের সংঘাত এবং একজন সাধারণ লেখকের কৈফিয়ত
সৈয়দ মবনু: সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ আমার দ্বিতীয় বাড়ি। হয়তো এদাবী আরো অনেক লেখক-সাহিত্যিকদের। আমার একথার সাথে যাদের দ্বি-মত, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রইল। এই সংসদে আমি আসা শুরু করি মায়ের পেটে বসে কিংবা বাবার মগজে থাকতে। আর যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, একেবারে ক্লাস টু- ত্রীতে, তখন থেকে নিজ পায়ে আসা শুরু। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ মুহম্মদ নুরুল হক খুব স্নেহ করতেন। তাঁর স্নেহ থেকেই আসা-যাওয়া। আস্তে আস্তে নিজে লেখালেখি শুরু করি। এক সময় সংসদের প্রতি প্রেম হয়ে যায়। অতঃপর জীবন সদস্য হই। আমার জীবন সদস্য নম্বার-৩৫০। এক পর্যায়ে কমিটির সদস্য হই। এ পর্যন্ত সবশেষ ২০১৩-২০১৪-এর কমিটিতে আমি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক হিসেবে বিনাপ্রতিন্দ্বীতায় নির্বাচিত হই। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ইতিহাসে সরাসরি ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন এ ছিল প্রথম। মহান আল্লাহর শোকর আদায় করি তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছাড়া যে আমাকে উত্তির্ণ করেছিলেন।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদকের প্রধান কাজ হলো সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর পরিচালনা আর সাহিত্য পত্রিকা ‘আল-ইসলাহ’ প্রকাশ। আলহামদুলিল্লাহ এ দুই দায়িত্বই আমি আমার সাধ্যমতে আদায়ের চেষ্টা করেছি। দায়িত্ব আদায়ের সফলতা-ব্যর্থতার বিচার-বিবেচনা আগামী প্রজন্মের হাতে। আমার দায়িত্ব লাভের পূর্বের সাহিত্য আসরগুলোর উপস্থিতি আর আমার দায়িত্ব লাভের পরের উপস্থিতি এবং অনুষ্ঠানের আলোচকদের তালিকা দেখে যে কেউ বিচার করতে পারেন এক্ষেত্রে সফলতা এবং ব্যর্থতা। এসবই খাতায় কিংবা বিগত দিনের আল-ইসলাহে লিপিবদ্ধ আছে। আর আল-ইসলার কথা কি বলবো? আল-ইসলাহও একটা ডকুমেন্টারী বিষয়। যেকোন মানুষ বিগত ৮২ বছরের সবগুলো আল-ইসলাহ হাতে নিয়ে বিচার করতে পারেন, ভালো না খারাপ হয়েছে।
আমি একথাগুলো বলছি না এজন্য যে কেউ আমাকে বাহঃ বাহঃ বলুক। আমি কোনদিনই বাহঃ বাহঃ পাওয়ার জন্য কাজ করি না। আমি কোনদিনই নিজের প্রসংশা শোনার জন্য সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করি না। বরং যারা করেন তাদেরকে পছন্দ করি না। আমি আমাকে শুধু একজন লেখক ছাড়া অন্যকিছু কোনদিন মনে করিনি। আমার বিশ্বাস, একজন লেখক মানে সমাজের শিক্ষক। প্রায় সময় বলেও থাকি,আমি সমাজের একজন অবৈতনিক শিক্ষক। কেউ আমাকে মানলে যা, না মানলেও তা। সবসময় আমি এই শিক্ষকের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে আদায়ের চেষ্টা করি। আমার এই আদায় হয়তো সবসময় ত্র“টিমুক্ত নয়, তবে নিজের মনকে পরিশুদ্ধ রাখতে আমি সর্বদা চেষ্টা করেছি। আমি নিজের কর্ম সম্পর্কে এখানে কিছুই বলতে চাই না। লেখালেখি করি আমি সেই শৈশব থেকেই। আর লেখা প্রকাশ হওয়া শুরু হয়েছে যতটুকু সম্ভব ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, তখন আমার বয়স দশ। ইতোমধ্যে ত্রিশের অধিক বই প্রকাশিত। আমি কোনদিনও কাউকে গিয়ে বলিনি আমার লেখা বা গ্রন্থের উপর আলোচনা লিখতে কিংবা আমার একটা বই পড়তে। আমি মূলত লেখালেখি করি নিজের অবস্থা বুঝার জন্য। নোট করে পড়লে যেকোন বিষয় ভাল করে বুঝা যায়, এই চিন্তা থেকেই আমার বেশির ভাগ প্রবন্ধ লেখা। আর গানÑকবিতা আমার আত্মার অনুবাদ। আমার খুব লজ্জা হয় কোন মানুষ যখন সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে। মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় কেমনে আমার বুঝতে কষ্ঠ হয়। একেবারে যৌবনের শুরুতে আমি একটা সংবর্ধনা পেয়েছিলাম। সেই সংবর্ধনার লজ্জায় আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে যাই। আর যারা নিজের টাকা খরচ করে সংবর্ধনা নেয় ওরা তো বিশ্ব বেহায়া এবং অত্যন্ত নির্লজ্জ। ওদের প্রতি মন থেকে প্রচুর ঘৃণা। এখন আমার সংবর্ধনা তো দুরের কথা, আমি আমার জানাজায়ও খুববেশি হৈ চৈ আশা করি না। তিনজনই আমার জানাজায় যথেষ্ট। যারা আমাকে ভালবাসেন না তারা জানাজায় এসে কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমি মনে করি যারা আমায় ভালবাসেন না তারা আমার জানাজার সময় এসে সময় নষ্ট না করে তখন নিজের জন্য কিছু করলে বেশি উপকার হবে। আমি প্রেমিক মানুষ, শুধু প্রেমিকদেরকে দেখতে ভালবাসি। যাক, এ সব বলতে আমি আজ লিখতে বসিনি। আজকের লেখার প্রসঙ্গ-কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে কর্তৃত্বের সংঘাত।
গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ছিল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ২০১৫-২০১৬ খ্রিস্টাব্দের কর্তা নির্বাচনের তারিখ। মোট তেইশটি পদের জন্য এখানে এখানে দুটি প্যানেল এবং কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছিলেন। ২৭ তারিখ দুপুর পর্যন্ত সেখানে নির্বাচনের কার্যক্রম চলছিল। আমি সকাল থেকেই সংসদে। নিজেও দুপুর ১২টার দিকে ভোট দিয়েছি। দুপুর ২টায় বাসায় আসি ছেলে-মেয়েকে ভোটের জন্য নিয়ে যেতে। আমি যখন বাসা থেকে বের হবো তখন ফায়যুর রহমান ফোন দিয়ে জানায়, কেমুসাসে মারামারি হয়েছে। সাথে সাথে আমি সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হামিদ মানিককে ফোন দিয়ে বিষয়টির সত্যতা জানি। তিনি সত্যতা স্বীকার করলে তাঁকে জিজ্ঞাস করি ছেলে-মেয়েকে ভোটের জন্য নিয়ে আসব কি না? তিনি না করলে আমি তাদেরকে রেখে খুব দ্রুত একটি সিএনজি নিয়ে কেমুসাসে যাই। তখন আমার সাথে ছিল সংসদের জীবন সদস্য আসিফ আজহার শিপু। সেখানে গিয়ে দেখি প্রচুর মানুষ কেমুসাসের সামনে সমবেত। সবাই বিষয়টি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করছেন। কিন্তু কে বা কারা করেছে তা কেউ বলতে পারছেন না বা জানলেও কেউ বলতে চাচ্ছেন না। সংসদের সামনের গ্লাস ভাঙ্গা। কষ্ট হয়। খুব কষ্ট। এই কষ্ট কোনদিন শেষ হবে না। তবে এই কষ্টের পাশাপাশি কিছু প্রশ্ন আসতে থাকে মনে
১) কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদকে যারা আক্রান্ত করেছে তাদের পরিচয় কি এবং তারা কেন আক্রান্ত করলো?
২) এই ঘটনার জন্য দায়ী কি শুধু তারা যারা আক্রমণ করেছে, না বর্তমানে যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন তারাও অনেকাংশে দায়ী?
৩) এই ঘটনার সূত্রপাত কি এদিনই হয়েছে, না এর কোন পূর্বসূত্র রয়েছে, থাকলে সূত্রগুলো কি কি?
৪) এই সংসদ আক্রান্ত হওয়ায় আমার কেন কষ্ট লাগছে?
৫) আমাদের পক্ষে কি সম্ভব এই আক্রমণকারীদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা?
৫) এই সাহিত্য সংসদের সাথে আমার সম্পর্ক কি এবং বাকী ১৭শ জীবন সদস্যের সম্পর্ক কি?
৬) কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ কি কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দলের প্রতিষ্ঠান?
৭) সাহিত্য সংসদের নির্বাচনে ডান, বাম, ইসলামিক সবার দলীয় প্রভাব বিস্তারের এত চেষ্টা কেন?
৮) লেখক-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান বলে খ্যাত এই সংসদের কমিটি গঠনে বা নির্বাচনে লেখকÑসাহিত্যিকেরা কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছেন?
৯) প্রতি দু বছর পরপর যে কমিটি গঠন বা কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচন হয় সেগুলোতে প্রার্থীদের প্যানেল কে বা কারা তৈরি করেন?
১০) দলীয় লেজশূন্য লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত কমিটি কি আমরা কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আশা করতে পারি না?
আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কে দেবে? অথচ সংসদের চলমান সমস্যার টেকসই স্থায়ী সমাধানের জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া খুবই জরুরী।