ইসলামের আলোকে বিনোদন
তারেকুল ইসলাম
প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ নানা কাজে ব্যস্ততা এবং বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কর্মক্লান্ত মানুষের আত্মিক সজীবতার জন্য প্রয়োজন বিশ্রাম ও বিনোদন। মানুষের শরীরের জন্য যেমন বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও ভিটামিন জরুরি, তেমনি তার আত্মার জন্যও বিনোদন, বিশ্রাম ও খাদ্য জরুরি। আনন্দ ও চিত্তবিনোদন মানুষের মধ্যে হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানিসহ অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতিকে মন থেকে মুছে দেয়। আনন্দের অনুভূতি মানুষকে প্রশান্তি দেয় এবং মনকে সুস্থ ও সতেজ রাখে। হজরত আলী বিন মুসা রেজা বলেন, আনন্দ ও চিত্তবিনোদন মানুষকে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে এবং এসবের সহায়তায় দুনিয়ার বা পার্থিব বিষয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া যায়। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের চিকিত্সার ক্ষেত্রেও আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলছেন, চিত্তবিনোদন, হাসি-খুশি ও প্রফুল্লতা বিভিন্ন ধরনের রোগপ্রতিরোধ করে এবং শরীরে নানা ধরনের ক্যান্সারের দ্রুত ছড়িয়ে পড়াকেও ঠেকিয়ে রাখে। চিকিত্সাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হাসি ও প্রফুল্লতা এমন এক অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া, যার ফলে মুখের ১৫টি মাংসপেশি একই সময়ে সঙ্কুচিত হয় এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ঘটে। এছাড়া হাসি ও প্রফুল্লতার সময় শরীরের রক্তপ্রবাহ দ্রুত সঞ্চালিত হওয়ায় রক্তে এড্রেনালিন বেড়ে যায়। এতে মানুষ আরও সজীবতা ও আনন্দ অনুভব করে। মানুষের জীবনে যদি আনন্দ ও প্রফুল্লতা না থাকত, তাহলে মানুষ মানসিক চাপের তীব্রতায় প্রাণ ত্যাগ করত। তাই জনগণের মধ্যে হতাশা দূর করা ও তাদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার জনগণের জন্য সুস্থ বিনোদন ও নিষ্কলুষ আনন্দের ব্যবস্থা করতে পারলে তা দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর বিনোদনের আড়ালে যেন বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখাও আবশ্যক। কেননা আমাদের বর্তমান সমাজে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিতান্তই বিনোদনের আদলে অশ্লীলতাপূর্ণ ও দেশীয় কৃষ্টিবিধ্বংসী ভিনদেশি সংস্কৃতিচর্চার অসুস্থ প্রবণতা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের দেশজ সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও আচারের মাধ্যমেও বিনোদন উপভোগ করা যায়। তাই যেহেতু বিনোদনের সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগ রয়েছে, তাই আমাদের বিনোদনের মাধ্যমগুলোকে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতিতে বিজাতীয় কৃষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটতে দেয়া যাবে না।
পরিবার ও সমাজের উন্নতির জন্যও দুঃখ ও হতাশা নিবৃত্তকরণে আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা জরুরি। আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া কেবল একজন মানুষের নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নয়; কারণ একজন মানুষের হাসি-খুশি মুখ এবং দুঃখভারাক্রান্ত বা ক্রুদ্ধ চেহারা অন্যদেরও প্রভাবিত করে। ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ডার বলেছিলেন, মানুষের স্মৃতি এবং অনুভূতি কেবল মগজের মধ্যেই সঞ্চিত থাকে না, মানুষের মধ্যে সামষ্টিক বা সামাজিক অনুভূতি নামে এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। আর এ অনুভূতি শক্তির মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। আর এ কারণেই অন্যের সুখ ও দুঃখ মানুষকে প্রভাবিত করে। অবশ্য মানুষের সুখ আপেক্ষিক বিষয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষ বিভিন্ন অবস্থায় আনন্দ পায়। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানীর মতে, সমাজের দুর্বল বা বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ ফুটবল খেলা দেখে বা এ ধরনের বিষয় থেকে আনন্দ পায়। আবার মধ্যবিত্ত বা অবস্থাপন্ন লোকরা অর্থ জমিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে আনন্দ বা সুখ উপভোগ করতে চায়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মনে করতেন, চিন্তাশীল জীবনের মধ্যে রয়েছে আনন্দ এবং এ আনন্দই হচ্ছে সর্বোচ্চ আনন্দ। আবার অনেক দার্শনিক ও গবেষক মনে করেন, কেবল ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনযাপনের মধ্যেই রয়েছে আনন্দ। পবিত্র ইসলাম ধর্ম মানুষের শারীরিক ও আত্মিক চাহিদাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়। ইসলাম মনে করে, একটি সফল জীবনের জন্য চিত্তের প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা থাকা জরুরি। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সুখ বা আনন্দ শব্দটি প্রায় ২৫ বার এসেছে। যারা মানুষের জন্য আনন্দ ও সুখের ব্যবস্থা করেন, পবিত্র কোরআন তাদের প্রশংসা করে এবং তারা পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবে বলে উল্লেখ করেছে। ইসলাম মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে আনন্দ উপভোগের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। অনেকে হয়তো মনে করেন, ইসলামী চেতনার কথা বললে বিনোদনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং শিল্প আর নান্দনিকতা বলতে জীবনে কিছু থাকবে না। আসলে তাদের এমন ধারণা নিছক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। মহানবী (সা.)-এর জীবন এমন অসংখ্য ঘটনা দ্বারা সমৃদ্ধ—যেখানে তিনি কবিতাচর্চা, নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, তীর-বল্লম দিয়ে খেলা, বলী খেলা, দৌড়, সাঁতার, কৌতুক, অশ্ব প্রতিযোগিতা ইত্যাদি খেলাকে উত্সাহিত করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেও অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি এসবের উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে গিয়ে তার কারণ হিসেবে মহানবী (সা.) বলতেন, ‘ইহুদি-খ্রিস্টানরা দেখুক যে, আমাদের ধর্মে সঙ্কীর্ণতা নেই।’ বিনোদনে ভালো ও মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। ভালো ও সুস্থ বিনোদন মানুষের কল্যাণপ্রয়াসী আর মন্দ ও অশ্লীল বিনোদন মানুষের নৈতিক, চারিত্রিক ও আত্মিক স্খলন ঘটায়। যারা মন্দ ও অশ্লীল বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ করে, তাদের জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা কুফরি করে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু-জানোয়ারের মতো উদরপূর্তি করে।’ এ ধরনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, বিনোদন ও উত্সব যেখানে খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই-ই, বরং থাকে উগ্রতা ও কুপ্রবৃত্তির তাড়না সেরূপ বিনোদন বা আনন্দ কোরানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সুস্থ বিনোদন বা নিষ্কলুষ আমোদ-প্রমোদ মানুষকে সুস্থ আনন্দ উপহার দেয়। রঙ-বেরঙের ফুল, সবুজ গাছপালা, ঝরনা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা প্রভৃতি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আমরা একদিকে যেমন আনন্দ উপভোগ করতে পারি, তেমনি কিছুটা হলেও মহান আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহকে উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। ভ্রমণ ও এর মাধ্যমে সুন্দর দৃশ্য দেখা বা জ্ঞান অর্জন করা সুস্থ বিনোদনের আরেকটি মাধ্যম। পবিত্র কোরআন মানুষকে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে অতীতের জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে বলে। ভ্রমণের কারণে মানুষের মনে জমে থাকা অবসাদ, একঘেয়েমি ও ক্লান্তি দূর হয় এবং মন সতেজ ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভ্রমণ মানুষের শরীরকেও সুস্থ রাখে। এজন্যই বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তোমরা সুস্থ থাকার জন্য ভ্রমণ কর।
শরীরচর্চা ও খেলাধুলাও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো, পিতা সন্তানকে লেখা, সাঁতার ও তীর চালনা শেখাবে এবং বৈধ আয়ের মাধ্যমে সন্তানের জীবিকা নির্বাহ করবে। বিভিন্ন উত্সব ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াও আনন্দ ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এজন্যই ইসলামধর্মীয় উত্সব বা দিবস ও ধর্মীয় নেতা বা মহান ইমামদের জন্মদিনে উত্সব পালন করাকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে উত্সবের নামে বাড়াবাড়ি, অপচয়, অর্থহীন কর্মকাণ্ড ও অপসংস্কৃতি বা অনাচারে জড়িয়ে পড়া নিষিদ্ধ। চিন্তাবিদদের মতে, অন্যদের সহায়তা করা এবং গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় ফরজ বা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য সম্পাদনও প্রকৃত ও অকৃত্রিম আনন্দের উত্স।
দুনিয়ার আকর্ষণ ও চাকচিক্য থেকে নিজেকে দূরে রাখাও প্রকৃত সুখ বা আনন্দের উত্স। ভোগবাদ, বিলাসিতা ও চাকচিক্যের প্রতি মোহ মানুষকে লোভী ও পরকালের প্রতি উদাসীন করে। লোভী মানুষ অনেক কিছু পেয়েও সন্তুষ্ট হয় না। এতে তার মধ্যে মানসিক অশান্তি বাড়তেই থাকে। তাই যারা দুনিয়ার বাহ্যিক জাঁকজমক ও চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় না, তাদের দৃষ্টি হয় অনেক উদার ও প্রসারিত। এ ধরনের মানুষ সামান্য সমস্যায় নতজানু হন না এবং তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও উঁচু মনোবলের অধিকারী হন। এক্ষেত্রে প্রার্থনা বা মোনাজাত মানুষের অন্তরে শক্তি জোগায় এবং আত্মাকে করে সজীব ও প্রাণবন্ত। কবিতা বা গজল আবৃত্তি, বিয়ের উত্সব, উপহার দেয়া, উজ্জ্বল রঙের জামা-কাপড় পরা, সুগন্ধি ব্যবহার, সুন্দর সাজে সজ্জিত হওয়া, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ এবং সর্বোপরি কর্ম ও সাধনায় জড়িত থাকা ইসলামনির্দেশিত নির্মল আনন্দের আরও কিছু মাধ্যম। পরিশেষে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একটি বাণী শুনিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, যে কেউ একজন মুমিনকে আনন্দ দিল, সে যেন আমাকে আনন্দ দিল, আর যে আমাকে খুশি করল, সে অবশ্যই আল্লাহকেও খুশি করল।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম