চরম অনিশ্চয়তায় সিরীয় শরণার্থী শিশুদের জীবন

Syriaউপসাগরের উপত্যকার পর উপত্যকায় তুষারাবৃত তাঁবু। তাপমাত্রা নিম্নগামী হতে হতে একদম শূন্যে এসে ঠেকেছে। বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে সাইবেরিয়া। কিন্তু সাইবেরিয়া নয়। বলা হচ্ছে, লেবাননে অবস্থিত সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরের কথা। দিন পনের আগে সাত বছরের যে শিশুটি হাড়-কাঁপানো ঠা-ায় মারা গেছে, শরণার্থী শিবিরের সাড়ে চার লাখ শিশুর মানবেতর অবস্থা তুলে ধরেছে সে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে যারা সীমান্তের ওপারে লেবাননে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ এখন প্রচ- ঠান্ডায় বিপর্যস্ত, পুষ্টিহীনতার কবলে পড়ে সহায়হীন এ মানুষগুলো দিশেহারা। এদিকে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শরণার্থীর সংখ্যা এরই মধ্যে ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনই এক বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে সিরিয়া থেকে লেবাননে যাওয়ার পথে মারা যায় তিন বছরের এক শিশু। তবে শত্রুর বুলেটে নয়, মারা গেছে তুষারঝড়ে। তার কয়েকদিন আগে লেবাননের বালবেকের শরণার্থী শিবিরে ৪৮ বছরের এক মহিলাও মারা যান। ওই মহিলার জন্য স্বস্তির খবর, তার দুই সন্তানকে দত্তক নিয়েছে এক লেবানিজ পরিবার। তবে এ ধরনের স্বস্তির খবর কালে-ভদ্রেই আসে শরণার্থী পল্লীতে। কারণ, তুষারঝড় ‘জিনা’ শরণার্থীদের জীবনকে একপ্রকার নরকই বানিয়ে ফেলেছে।
নিজেদের মানবেতর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে এক শরণার্থী নেতা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শিশুরা অতিরিক্ত ঠা-ার কারণে কাহিল হয়ে পড়ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায়ও ছটফট করছে। খাবার সরবরাহ ক্রমেই কমে আসছে। শিশুদের পড়াশোনার সুযোগও সঙ্কীর্ণ হচ্ছে। কখন যে কষ্টের শীত শেষ হবে, এই ভাবনায় দিন পার করছে অধিকাংশ শরণার্থী। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে ৭০ হাজার শীতের পোশাক বিতরণ করা হলেও চাহিদার তুলনায় তা ছিল খুবই নগণ্য।
দাতা সংস্থাগুলো বলছে, তুষারঝড় এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে মজুদ থাকা খাদ্য, পোশাক এবং চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছতে পারছে না। তবে তুষারঝড়ের কারণে খাদ্য এবং চিকিৎসা সামগ্রী না পৌঁছলেও শরণার্থী শিবিরে শিক্ষার অভাবটাকেই বড় করে দেখছেন অভিভাবকরা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে শরণার্থী শিশুদের জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন কমই চোখে পড়েছে। এ কারণে সিরিয়ার শরণার্থীদের শিক্ষার উন্নয়নে লেবানন সরকারের পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছিল, তা সাফল্যের মুখ দেখছে না। সিরিয়ার পাশাপাশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বড় একটি অংশও লেবাননে অবস্থান করায় সবার জন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে বেশ ধকলই সামলাতে হচ্ছে লেবানন সরকারকে।
অপরদিকে, শরণার্থী শিবিরের শিশুদের বড় একটি অংশ খাবার এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অনেকের বাবা-মা তাদের ভিক্ষাবৃত্তির মতো কাজে বাধ্য করছে। ফলশ্রুতিতে শিবিরেই শিশুশ্রম এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে হতভাগ্য শিশুরা। এর মধ্যে অনেকেই আবার জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে। ফলশ্রুতিতে নিজের জীবনকে বিপথে টেনে নেয়ার পাশাপাশি অন্যের জন্যও হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
সবশেষ হিসাব মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শরণার্থী সংখ্যা এরই মধ্যে ৬০ লাখে গিয়ে ঠেকেছে। ১৯৪৫ সালের পর শরণার্থী সংখ্যার এ ধরনের বৃদ্ধিকে এখন পর্যন্ত মানবতার সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে ধরা হচ্ছে। খাদ্য এবং শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার অভাবের কারণে এ বিপর্যয় ক্রমেই বৃহদাকার ধারণ করছে। আন্তর্জাতিক মহলের অসহায়তার কারণেই মূলত এ ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘব করতে লেবানন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা পূর্ণতা পাচ্ছে না তহবিল সঙ্কটের কারণে।
এভাবেই শরণার্থী শিবিরে শিশুদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তাদের খাদ্য এবং শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে তুষারঝড় যোগ হওয়ায় রীতিমতো বিষিয়ে উঠছে শিশুদের জীবন। কারণ, শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় উষ্ণ পোশাক থেকে বঞ্চিত এই শিশুরা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বের দাতা সংস্থাগুলো চাইলে এ সমস্যা লাঘব করা অনেকাংশেই সম্ভব। এজন্যই শরণার্থী শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র এবং শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের জন্য আবেদনটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। এ আবেদন মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে মানবতার এই বিপর্যয় আরো খারাপ হবে। যা এক সময় ট্র্যাজেডিতেও রূপান্তর হতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী চাইলেই এ ট্র্যাজেডি থেকে শরণার্থী শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু তা আর হচ্ছে কোথায়?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button