ইসলামিক স্টেটের মোকাবিলায় ব্রিটেনের কোনো পরিকল্পনা নেই
২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনে জড়িত হওয়ার ক্ষত সৃষ্টিকারী অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার দেশটির সাথে যতটা কম সম্ভব সংশ্লিষ্টতার নীতি গ্রহণ করে।
২০১৪ সালের বসন্তকাল নাগাদ ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদের ব্যাপক আক্রমণাভিযানে যখন ইরাকের এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয় তখন বাগদাদের ব্রিটিশ দূতাবাসের রাজনৈতিক শাখাটি গঠিত ছিল স্বল্পকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত মাত্র ৩ জন জুনিয়র কূটনীতিককে নিয়ে। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ইরাকে ব্রিটিশ সামরিক কার্যক্রমের ঘাঁটি ছিল ইরাকের তেল শিল্পের কেন্দ্রস্থল বসরা। ২০১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বসরার ব্রিটিশ কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জিহাদপন্থী সংগঠনটি যখন ইরাকের বিরাট অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় সে মুহূর্তে এ সংগঠনটির কার্যক্রম ছিল ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের গুরুত্বাধীন বিষয়। প্রকৃতপক্ষে আইএসের মোকাবিলায় ব্রিটেনের কোনো পরিকল্পনা নেই।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত হাউস অব কমন্স প্রতিরক্ষা কমিটির রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে ব্রিটেনের ভূমিকা সম্পর্কে সত্যিকারভাবে জানতে ইচ্ছুক সকলেই এ রিপোর্টটি পড়ে দেখা উচিত। এ থেকে দেখা যায় যে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার শুধু বাগাড়ম্বরই করেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ও সামরিক কোনো নীতি প্রণয়নের ধার ধারেনি। এক্ষেত্রে সমস্যা যেটা ছিল তা হল, সরকারের অস্বীকৃতি যে ইরাকে কী ঘটছে তা জানার উপযুক্ত পন্থা তাদের ছিল না। কমিটির রিপোর্টে বলা হয় যে ইরাকে দীর্ঘকালের সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ইরাকের গোত্রগুলো বা রাজনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান সম্পন্ন বা ইরাকি মিলিশিয়াদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন এমন কোনো ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ইরাকে ছিলেন না।
এখন বিশ্বের অন্যতম এক বিপজ্জনক স্থানে ব্রিটেন আরেকবার সামরিকভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। আর যদি তা রোজ একবার করে বিমান হামলা পরিচালনার মধ্যে সীমিত থাকত, তাও হতো। ইরাকে ব্রিটেন কি করতে চায়, তা সে জানে না। রিপোর্টে বলা হয়, ইরাকে যুক্তরাজ্যের লক্ষ্য ও কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো বাহিনী প্রধানেরই সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার বিবৃতি দানের অক্ষমতা বা অনিচ্ছায় কমিটি মর্মাহত। ইরাক বিষয়ক নীতির দায়িত্ব কার বা আদৌ এ রকম নীতি আছে কি না সে বিষয়েও কোনো ব্যাখ্যা নেই।
বাহিনী প্রধানগণ কমিটির প্রশ্নের জবাবে ইরাক বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা জানান। ইরাকে ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ পদক্ষেপ নির্ধারণের দায়িত্ব কার এ প্রশ্নের জবাবে এয়ার চিফ মার্শাল স্যার অ্যান্ড্রু পুলফোর্ড বলেন, এর জবাব হল সম্ভবত প্রায় ২০ জন খেলোয়াড় রয়েছেন যারা ইরাক ও সিরিয়া এবং এ অঞ্চল ঘিরে প্রযোজ্য ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপের বিভিন্ন বিষয় ও দিক নির্ধারণ করেন।
নীতি নির্ধারণকারী কে? এর জবাব হচ্ছে সহজ ও বিপর্যয়কর- যুক্তরাষ্ট্র। রিপোর্টে বলা হয়, মিশন অথবা কৌশলের বহু প্রশ্ন বিভিন্ন সরকারি বিভাগের শূন্যতার মধ্যে অথবা আন্তর্জাতিক জোটের কাছে (যা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝায়) ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার সামগ্রিকভাবে জোটের কৌশল বিশ্লেষণ, প্রশ্ন বা পরিবর্তন করতে চায় আমরা এমন কোনো প্রমাণ পাইনি।
মার্কিন নীতির প্রতি দুর্বল সমর্থন কোনো সমাধান বয়ে নাও আনতে পারে। জানুয়ারিতে মার্কিন সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জেমস ম্যাটিস বলেন, যে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলমুক্ত অবস্থান নিয়েছে। একই সাথে সে আইএসের নির্মূলিকরণ চায় এবং আইএসের প্রধান শত্রু বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করারও চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র বাশার ও আইএসের বদলে উদারপন্থী বিদ্রোহীদের ক্ষমতাসীন করতে চায়।
ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে মার্কিন নেতারা সম্ভবত আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের উভয় সংকট উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। তারা এমন একটি জোট গঠন করেছেন যাতে আইএসের বিরুদ্ধে যারা মাঠে লড়াই করছে তারা নেই, বরং তারা আছে যারা গ্রুপটিকে লালনে সহায়তা করেছে। আইএস ও আল কায়েদা জাতীয় সংগঠনের উত্থান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কীভাবে তা প্রকাশিত হয় গত অক্টোবরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছোট সভায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অকূটনীতি সুলভ সরলতায়। বাইডেন সেদিন যা বলেছিলেন আজ সবাই তা ভুলে গেছে, কিন্তু তা পরিস্থিতি সম্পর্কে বহু আমেরিকান নেতার ভাবনাকেই নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত করেছে। বাইডেন বলেন, সউদী আরব, ইউএই ও তুরস্ক বাশারের পতন ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল এবং তারা শিয়া-সুন্নী ছায়া যুদ্ধে জড়িত হয়। তারা কি করেছে? এ জন্য আল নুসরা ও আল কায়েদা ছাড়া যারা আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তাদের তারা শত শত কোটি ডলার ও হাজার হাজার টন অস্ত্র দিয়েছে।
ইরাকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন আইএস সিরিয়া গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। বিখ্যাত ‘উদারপন্থী’ যারা বাশার ও আইএসকে মোকাবিলা করতে যাচ্ছে তাদের সম্পর্কে বাইডেন বলেন, এখানে কোনো উদারপন্থী-মধ্যবর্তী নেই, কারণ উদারপন্থী-মধ্যবর্তীরা দোকানিদের নিয়ে গঠিত সৈন্যদের নিয়ে নয়। ব্রিটেন ইরাক সরকারের সাহায্যের জন্য কি করতে পারে একজন ইরাকিকে এ প্রশ্ন করা হলে সে আধা রসিকতা সহকারে বলে, সউদী আরবে বোমা ফেলতে পারে।
ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেন এক গৌণ খেলোয়াড়। তবে একজন গৌণ খেলোয়াড়ও বড় ধরনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে। যেমন জর্দান। গত সপ্তাহে তারা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। গর্দানি পাইলটকে হত্যা করে আইএস সম্ভবত বার্তা পাঠাতে চেয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা কমিটির রিপোর্ট পড়ে মনে হয়, ইরাক ও সিরিয়ায় এবং ঐ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানে কি ঘটছে সে বিষয়ে ব্রিটিশ রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানে কারোরই বেশি ধারণা নেই। রিপোর্টে বাগদাদ ও আরবিলে আইএসবিরোধী সরকারের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, সুন্নী সম্প্রদায়, ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী, পেশমের্গা, শিয়া-মিলিশিয়া ও আইএসের ওপর পৃথকভাবে নজরদারির জন্য ইরাকে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ মোতায়েন যাতে ব্রিটেন ইরাকের প্রকৃত পরিস্থিতির নিরপেক্ষ মূল্যায়নের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। সূত্র দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।