অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ইরাক
রোকেয়া রহমান:
গত সপ্তাহের ঘটনা। বহু বছর পর যুক্তরাজ্য থেকে জন্মভূমি ইরাকে ফিরেছেন হায়দার (৪৮)। বাগদাদের বিমানবন্দরে বিষণ্ন মুখে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর এক ভাই। কিন্তু হায়দারের চোখ খুঁজছিল অন্য একজনকে, প্রিয় ছোট ভাই আলিকে। ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন হায়দার, ‘আলি কোথায়?।’ প্রশ্ন শুনে ভাই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। জানালেন মর্মান্তিক এক খবর। গত মাসেই এক গাড়িবোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আলি।গত জুলাই মাসে ইরাকে গাড়িবোমা হামলাসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় এক হাজার মানুষ। এ সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। চলতি বছর সব মিলিয়ে সহিংসতায় নিহত হয়েছে চার হাজারের বেশি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক যেন আবার পুরোমাত্রার এক গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে সাম্প্রতিক সময়ের বেশির ভাগ বোমা হামলার জন্য দায়ী আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত সুন্নি চরমপন্থী সংগঠন ইসলামিক স্টেট অব ইরাক। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানের সময় জিহাদি এ সংগঠনটি গড়ে ওঠে। দেশের শিয়া-অধ্যুষিত এলাকাগুলো তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ১০ লাখ সদস্য নিয়ে গঠিত ইরাকের বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী এসব হামলা ঠেকাতে পারছে না। সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
ওম জয়নাব নামের একজন শিয়া মুসলিম নারী বলেন, ‘বাগদাদের কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার জন্য আমাকে বহু চেক পয়েন্ট পার হতে হয়। সবখানেই সেনা ও পুলিশ মোতায়েন থাকে। কিন্তু তারা কখনোই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’
গত মাসে আল-কায়েদার জঙ্গিরা ইরাকের সবচেয়ে বড় কারাগার আবু গারাইবে হামলা চালায়। প্রায় ৫০০ জঙ্গি কড়া নিরাপত্তার এই কারাগারের তালা ভেঙে আল-কায়েদার বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ প্রায় ৫০০ বন্দীকে মুক্ত করে নিয়ে যায়।
কেন ইরাক সরকার তার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, বিবিসির এমন এক প্রশ্নের জবাবে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদমান বলেন, ‘আমি এটাকে ব্যর্থতা বলতে চাই না। জনগণকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমরা যেসব বাধা ও সমস্যার মুখে পড়ছি, তা-ও বিবেচনা করতে হবে। তা ছাড়া শুধু ইরাক নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যই এখন জ্বলছে। সবখানেই সহিংসতা হচ্ছে। এখানে হতাহতের সংখ্যা হয়তো অনেক বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইরাক বিরাট একটি দেশ। আমরা আমাদের কাজ করছি, সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করছি এবং তাদের বিচারের আওতায় আনছি।’
সুন্নি-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে কেউ এসব হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। সুন্নিরা অভিযোগ করেছে, ইরাকের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের (সুন্নিদের) ওপর হামলার ঘটনাগুলোকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না। তাদের অভিযোগ, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী একজন শিয়া মুসলিম বলে তিনি সুন্নিদের ওপর শিয়াদের হামলাকে সমর্থন করছেন।
কয়েক মাস ধরে সুন্নি মুসলিমদের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করছে। বিক্ষোভকারীদের নেতা শেখ মুস্তফা আল বায়াতি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার জন্য নয়, আমরা প্রধানমন্ত্রীর বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে এসব বিক্ষোভ করছি।…আমরা শিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি না। আমরা তো শত শত বছর ধরেই তাদের পাশাপাশি বাস করছি। এ লড়াই সরকারের বিরুদ্ধে, যারা কিনা আমাদের অন্যায়ভাবে জেলে ভরছে। আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।’
সুন্নিরা ইরাকে সংখ্যালঘু। তাদের বেশির ভাগের বসবাস দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে। সরকার সেখানে সাংবাদিকদের (বিশেষ করে বিদেশি প্রচারমাধ্যমের) যেতে দেয় না।
এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ইরাকের জনগণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। এ রকমই একজন সুন্নি ট্যাক্সিচালক মোহাম্মদ জায়েদ। তিনি বলেন, ‘ইরাক একটি সম্পদশালী দেশ। কিন্তু এখানে কোনো সুখ নেই, কোনো স্থিতিশীলতা নেই। ভবিষ্যতে এখানে কী হবে, কেউ জানে না। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। সুযোগ পেলেই ইউরোপ বা আমেরিকায় চলে যাব।’