বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে এইচএসবিসি
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। কর ফাঁকি দিয়ে ব্যাংকটির সুইজারল্যান্ড শাখায় এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে।
এইচএসবিসির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার (প্রায় ১০০ কোটি টাকা)। ১৭টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৬ জন গ্রাহক এ অর্থ পাচার করেছেন। এর মধ্যে ব্যক্তিগত হিসাব রয়েছে ১০টি ও অফশোর কোম্পানির অ্যাকাউন্ট সাতটি।
ব্যক্তিগত ১০ অ্যাকাউন্টের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রয়েছেন পাঁচজন। তবে অর্থ পাচারকারীদের পরিচয় জানা যায়নি। এর মধ্যে একজন সর্বোচ্চ ৪৪ লাখ ডলার পাচার করেছেন।
১৯৮৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এইচএসবিসির সুইস প্রাইভেট ব্যাংকে বাংলাদেশীদের ৩৪টি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এর মধ্যে ৩১টি অ্যাকাউন্ট এখনো সচল। আর অ্যাকাউন্ট খোলার এ প্রবণতা বেড়ে যায় ২০০০ সালের পর।
এ ব্যাপারে এইচএসবিসির মুখপাত্র ও সুইজারল্যান্ড প্রাইভেট ব্যাংকিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রাঙ্কো মোরা স্বাক্ষরিত এক ই-মেইল বার্তায় বলা হয়, ‘এসব তথ্য এইচএসবিসির পুরনো ব্যবসায়িক অনুশীলন সম্পর্কিত। এখন আর এইচএসবিসির সুইস প্রাইভেট ব্যাংক পুরনো বিজনেস মডেল অনুসরণ করে না। কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং রোধে ২০০৮ সাল থেকে এইচএসবিসি সুইস প্রাইভেট ব্যাংক আমূল সংস্কার শুরু করেছে। নতুন সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আমাদের নতুন স্ট্যান্ডার্ড ও উচ্চমাত্রার কমপ্লায়েন্সের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় এরই মধ্যে অনেক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব গ্রাহক আমাদের আর্থিক অপরাধ সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড মানেন না, তাদের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখছে না এইচএসবিসি।’
২০০৭ সালের শেষের দিকে এইচএসবিসির সুইস শাখার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী হার্ভে ফালসিয়ানি এক লাখের বেশি গ্রাহকের তথ্য চুরি করে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। মূলত ওই তথ্যের ভিত্তিতেই যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান, ফরাসি পত্রিকা লা মঁদ, বিবিসি প্যানোরামা ও ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এইচএসবিসির মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে।
এতে দেখা যায়, ২০৩টি দেশ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার গ্রাহক প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার কর ফাঁকি দিয়ে এইচএসবিসির সুইজারল্যান্ড শাখায় জমা করেছেন। কর ফাঁকিতে সহায়তা ছাড়াও স্থানীয় কর কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য লুকানোয় সহায়তা ও মানি লন্ডারিংয়েও জড়িত এইচএসবিসি। ব্যাংকটির মাধ্যমে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের বিষয়টিও উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপপ্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধে আমরা নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করছি।’
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৩ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার সমমূল্যের। ২০১২ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের অন্তত ২২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত ছিল; ডলারের হিসাবে যা প্রায় ২৪ কোটি ৫০ লাখ।
এক দশকের মধ্যে ২০১৩ সালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত ছিল। এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত ছিল ২০০৭ সালে। সে বছর সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
২০০৮ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৭০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০০৯ সালে তা কিছুটা বেড়ে হয় ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ ও ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। তবে ২০১১ সালে তা বেশ কমে যায়। সে বছর জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৩-১২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার অবৈধভাবে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০০৬ সালে, ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। সে সময় অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চলে যায় ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এ প্রবণতা কিছুটা কমে। তবে ২০১২ সালে অর্থ পাচার ২০০ শতাংশ বা তিনগুণ বেড়ে যায়। সে বছর পাচার হয়েছিল ১৭৮ কোটি ডলার। আর ২০১১ সালে অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চলে যায় ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জিএফআই যৌথভাবে প্রণীত ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ: ১৯৯০-২০০৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও অর্থ পাচারের প্রমাণ মেলে। ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৪১৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার পাচার হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচারকৃত অর্থের একটি মাধ্যম এইচএসবিসি ব্যাংক। তবে অন্যান্য বহুজাতিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এতে জড়িত থাকতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেন এবং হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংককে রোধ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের বাইরে যাওয়ার সময় কেউ যাতে অতিরিক্ত অর্থ সঙ্গে নিয়ে যেতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।