ঘুরে এলাম ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপ

Indunasia2এ.এম. জিয়া হাবীব আহসান: এবার সিঙ্গাপুর থেকে সমুদ্র পথে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। আকাশ পথে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় একাধিকবার ভ্রমণের তৃপ্ত অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেল ক্রুজারে করে হাজার দ্বীপের দেশ ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপ সফর এর অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা মাত্র ০২ দিনের হলেও দেশটির মানুষ, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, দেশপ্রেম, অর্থনীতি, আইনশৃংখলা সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করি।
বন্ধুবর সাংবাদিক হাসান আকবর এর ভ্রমণ কাহিনী পড়ে আমার সহধর্মীনি অধ্যক্ষা আশফা খানম দেশটি সম্পর্কে আমার মাঝে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের বাসনা জাগিয়ে দেয়। বিশেষ করে তাঁর লেখায় দেশটিকে লাখপতি/ কোটিপতির দেশ হিসেবে নামকরণ করে মজার মজার অভিজ্ঞতা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হয়। আমাদের এ-বার হিউম্যান রাইটস এক্সপেরিয়েন্স শেয়ারিং প্রোগ্রাম এর স্থান সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া থাকলেও বন্ধুবর এডভোকেট মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন মাঝখানে সমুদ্র পথে ইন্দোনেশিয়ার বাটাম প্রভিন্স দেখার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আমি সহ অপর ২ সফর সঙ্গী যথাক্রমে ভগ্নিপতি এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও স্নেহধন্য মানবাধিকার আইনজীবী সৈয়দ মোহাম্মদ হারুন তাতে একমত পোষণ করেন। আল্লাহর শুকরিয়া, এভাবে আচমকা এ অচিন দেশটিকে দেখার সুযোগ হয়ে যায়। সেভাবে হলি ডে ফেয়ার এজেন্সির পরিচালক এমরান হোসেনকে আমাদের সিডিউল সাজাতে বলি।
সিডিউল অনুযায়ী আমরা গত ১৬ জানুয়ারী ২০১৫ শুক্রবার রাত ৯.০০ টায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টাইগার এয়ার এর ফ্লাইট নং টি.আর ২৬৫৭-এ করে সিঙ্গাপুর সময় রাত ৩.০০ টায় চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছি। বিমান বন্দরের অৎৎরাধষ খড়ঁহমব টি কার্পেটে মোড়ানো কি ছিমছাম সাজানো গোছানো। দেখে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। স্বল্প সময়ের ইমিগ্রেশান শেষে লাগেজসহ টেক্সি করে ৩০১, সারাংগুন রোডে অবস্থিত নির্দিষ্ট বুকিং দেয়া হোটেলে গিয়ে উঠি। হোটেলটি খুব পছন্দ হয়েছে এজন্যে যে, আমাদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী মোস্তফা মার্কেটের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। নাম “দি ক্ল্যারমন্ট হোটেল” সিঙ্গাপুর। পায়ে হেঁটেই লিটল ইন্ডিয়া সহ আশে পাশে ভ্রমণ করা যায়।
Indunasia২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর পুলিশ এর আমন্ত্রণে ‘কম্যুনিটি পুলিশিং” এর একটি মানবাধিকার ট্রেনিং প্রোগ্রামে গিয়ে সিঙ্গাপুর এর আইন শৃংখলা সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা ছিল।
বিশ্বের নিরাপদ নগর রাষ্ট্র নামে খ্যাত এ পুলিশি রাষ্ট্রের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সকলকে হতবাক করে দেয়। টেক্সি ক্যাব ভাড়া থেকে শুরু করে কোন ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও প্রতারণা ধরা পড়েনি। তবে শহরটি খুবই ব্যয়বহুল (ঈড়ংঃষু), তাই সফর সঙ্গীদের এব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম যে, এটা নির্বিঘ্নে নিরাপদে বেড়ানোর জায়গা, শপিং এর জন্য “মালয়েশিয়া” উত্তম। ৩ দিনে সিঙ্গাপুরকে চষে বেড়ালাম। যেন বহু চেনা বহু পুরানো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরে পেলাম। সেন্তোষা, সী এক্যুরিয়াম, জুরান পার্ক, চায়না টাউন, বোটানিক্যাল গার্ডেন আরো কত কি। মালয় উপদ্বীপের নিকটে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। এটি দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়াতে মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্তে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের স্থলভূমির মোট আয়তন ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার। এটি মালয়েশিয়া থেকে জোহর প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ। এর সরকার সব সময়েই স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে বহির্বিশ্বে সুপরিচিত। সিঙ্গাপুর আমাদের দেশের মাত্র ৫/৬ বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করে। মালয়েশিয়ার রাজা টিংকু আবদুর রহমান বোঝা মনে করে দেশটিকে নিজ দেশ থেকে আলাদা করে ঝেড়ে ফেলে। আজ তারা বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় নগর রাষ্ট্র। মারলিন বা সিংহ মৎস্য হচ্ছে সিঙ্গাপুরীদের গর্বের প্রতীক, বীরত্বের প্রতীক। কথিত আছে বহু পূর্বে সিঙ্গাপুর যখন তেমাসেক বা সমুদ্র নগরী নামে পরিচিত ছিলো। তখন প্রচন্ড এক সামুদ্রিক ঝড় উঠে দ্বীপে। আধিবাসীরা যখন নিজেদের সঁপে দেয় সৃষ্টিকর্তার হাতে ঠিক তখনই সমুদ্র থেকে সিংহ মৎস্য আকৃতির এক জন্তু এসে ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচিয়ে দেয় অধিবাসীদের। আর সে থেকে মারলিন নামে সিংহ মৎস্য দেবতা সিঙ্গাপুরীদের গর্বের আর বীরত্বের প্রতীক। মারলিনের মূর্তি ম্যারিলা বে-এ মারলাওন পার্কে অবস্থিত। মোস্তফা মার্কেটের আশেপাশে অনেক বাংলাদেশী হোটেল রয়েছে যেখানে নানা পদের খাবার এর কি মজাদার স্মৃতি। ১৯শে জুন ২০১৫ সকাল ৯.৩০ এ ইন্দোনেশিয়ার বাটাম এর উদ্দেশ্যে আমাদের ক্রুজার ছাড়ার সময়। তাই ভোরে হোটেলে কমপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়লাম। টেক্সি ষ্ট্যান্ড থেকে টেক্সি নিয়ে হার্বার ফ্রন্ট বাটাম সেন্টারে সকাল ৮টায় পৌঁছে গেলাম। জেটিতে ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল বিশাল কোন আধুনিক মার্কেটে ঢুকছি। ইমিগ্রেশান, টিকেট কনফার্ম ইত্যাদি কাজ সেরে এবার নাস্তার পালা। হারুন ভাইয়ের একটি কথা “খাবারের সাথে নো কম্প্রোমাইজ, যেখানে যাবো সেখানে সেখানকার স্থানীয় খাবার ফলমুল খাবো।” এটা ছিল তার মিশন। তবে শর্ত ছিল হালাল ফুড। নাস্তা করতে করতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জেটির বাইরে তাকাচ্ছিলাম। চোখে দূর দূরান্তের বহু ক্যাবল কার চোখে পড়লো। একটি দেশকে কিভাবে সাজানো যায় তার চমৎকার উদাহরন সিঙ্গাপুর। সময় মতো লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম শীপে উঠতে। ক্রুজারটি খুবই সুন্দর ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। ইন্দোনেশিয়ার বাটাম দ্বীপ এর সাথে সিঙ্গাপুরের খুব যোগাযোগ আছে বুঝলাম যাত্রীদের জাতীয়তা দেখে। সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের ২ঘন্টা সময়ের ব্যবধান। সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ উপকূল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপ এলাকার আয়তন সিঙ্গাপুরের সমান। ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান ১ ঘন্টা। স্বচ্ছ পানির সমুদ্রের বুক চিরে মাত্র এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ইন্দোনেশিয়ার বাটাম জেটিতে। ইমিগ্রেশন সিষ্টেম দেখে মনে হলো এটাও যেন সিঙ্গাপুর। খুব দ্রুত সব কিছু লাইন ও শৃংখলার সাথে শেষ হলো। জেটি থেকে বের হতেই টেক্সি কাউন্টার এ ডিউটিরত ব্যক্তিকে বীজ (ইওত) হোটেল, বাটাম বলতেই একটা স্লিপ কেটে ২০,০০০ ইন্দোনেশিয়ান রুপি ভাড়া লিখে দিল। ইতিপূর্বে মিয়ানমার সফরকালে হাজার টাকার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবার লাখ টাকার অভিজ্ঞতা আমাদের চমকে দিল। স্লিপ দেখাতেই ড্রাইভার আমাদের লাগেজগুলো টেক্সিতে তুলে নিল। আমরা দু’পাশে দেশটির সৌন্দর্য দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমরা/ আমাদের দেশ এখনও কোথায় পড়ে আছি। দালান কোঠা, ফ্লাইওভার এসবের উন্নয়ন হলেও আইন শৃংখলা,পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায়, নাগরিক সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদিতে আমরা ইন্দোনেশিয়ার এ দ্বীপটির থেকেও অনেক পিছিয়ে। পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতেও আকৃষ্ট করতে তাদের প্রস্তুতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী মনে হলো। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের মালিক হয়েও আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। ক্ষমতায় যে যায় সে তার আখের গোছানোর তালে ব্যস্ত, তার উপর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতা আমাদের পর্যটন শিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের টেক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে যে দেশ প্রেম দেখেছি আমাদের দেশের বহু বড় বড় আমলা ও রাজনীতিকদের মাঝে তা দেখিনি। বাটাম দ্বীপ সিঙ্গাপুর মালেয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ত্রিদেশীয় বিনিয়োগ সমৃদ্ধ ফ্রি ট্রেড জোন বিধায় জিনিসপত্রের দাম সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম। এখানে জাহাজ শিল্প ছাড়াও বহু ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাষ্ট্রি রয়েছে। সাংবাদিক হাসান আকবর ভাই ঠিকই লিখেছেন উন্নত বিশ্বের সারিতে ইন্দোনেশিয়ার নাম নেই। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশটি উন্নতও নয়, তবুও ভীষণ রকমের সুন্দর সমৃদ্ধ এ-দেশটি। পর্যটন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভর করে দেশটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বীজ হোটেলে পৌঁছার আগে পথিমধ্যে মানি এক্সচেঞ্জে ১০০ ইউ.এস ডলার ভাঙ্গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ১২ লক্ষ রুপি পেলাম। যেন পিলে চমকানোর মতো ব্যাপার। টাকার মান কম হলেও তাদের অর্থনীতি নড়বড়ে নয়। শক্ত ভীতের উপর দন্ডায়মান। পঞ্চাশ হাজার, বিশ হাজার, দশ হাজার এমনকি একলাখ টাকার মুদ্রাও রয়েছে নইলে বাজারে টাকা থলে ভর্তি করে নিতে হতো। এক হাজার টাকার মুদ্রার যেন কোন দামই নেই। তাদের একলক্ষ টাকা মানে আমাদের এক হাজার টাকারও কম। রাস্তাঘাটে লেটেষ্ট মডেলের জাপানি, বৃটিশ এবং আমেরিকান গাড়ীও দেখা যায়। তবে শহরটিকে মনে হলো যেন মটর সাইকেলের শহর। গাড়ীতে কোন হর্ন বাজানো হয় না। যার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। বাটাম দ্বীপের সৌন্দর্য্য দেখে জাকার্তা কেমন সুন্দর হবে তা অনুভব করা যায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button