মুসলমানরা কি আর ব্যালট বাক্সে আস্থা রাখবে?
বড় ধরনের সংকটে পড়েছে মিশর। যে সংহতি এই জাতিকে ১৯৫২ সালের রাজতন্ত্রের পতন এবং নাসেরের শাসন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ রাখতে সাহায্য করেছে, সাম্প্রতিক গণহত্যার ফলে তা ভেঙ্গে পড়েছে। এই সংহতি ছিল মৈত্রী ও দেশপ্রেমের। সর্বপরি অখণ্ড রাখার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেখানে সরাসরি গুলি বর্ষণ আর নির্মমতার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মিশরির গণতন্ত্রের পথই ছিন্ন হচ্ছে সেখানে একশ-দুশ-তিনশ শহীদে কোন তারতম্য নেই। তাহলে মুসলিম নর-নারী তাদের ধর্মের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র চাচ্ছে তা কিভাবে আবারো ব্যালট বাক্সের উপর আস্থা রাখবে? এটিই আজকের রক্তঝরা বাস্তব গল্প।
কেউ এটা দেখে বিস্মিত হতে পারে যে, কায়রোর রাস্তায় রাস্তায় ব্রাদারহুড সমর্থকরা একে ৪৭ রাইফেলে সজ্জিত ছিল। একই সঙ্গে রাজধানীর মধ্যবিত্ত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী এবং ‘অন্তঃর্বর্তী সরকারের’ সমর্থকরাও ছিল। কিন্তু কেউই তাদের অস্ত্র জব্ধ করে নেয়নি। এটি ব্রাদারহুড বনাম সেনাবাহিনী নয়। বামপন্থি ও ধর্মনিরপেক্ষ, খ্রিস্টান এবং গ্রামের সুন্নি মুসলমান, জনগণ ও পুলিশের, ব্রাদারহুড ও সেনাবাহিনীর মধ্যে নিষ্ঠুর বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এ কারণেই মোহাম্মদ এল বারাদে গতরাতে পদত্যাগ করেন। ১৯৯২ সালে আলজেরিয়া অথবা ২০১৩ সালের কায়রো। কে জানে আগামী কয়েক সপ্তাহ অথবা মাসের মধ্যে তিউনিশিয়ায় কি ঘটতে যাচ্ছে? মুসলমানরা গণতান্ত্রিকভাবে সাধারণ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তারা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কে ভুলে যাবে হামাসের পক্ষে ফিলিস্তিনিদের ভোট? এটি কোন ব্যাপার না যে মিশরে অনেক ভুল করেছে ব্রাদারহুড। কোন ব্যাপার না যে এলোমেলো বা বোকার মত ছিল তাদের শাসন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুরসি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পদচ্যুত হয়েছেন। এটি একটি ‘অভ্যুত্থান’, জন ম্যাককেইন এ শব্দের যথার্থ ব্যবহারই করেছিল।
টনি ব্লেয়ার জেনারেল আব্দুল-ফাতাহ্ আল সিসিকে সমর্থন দিতে গিয়ে আসন্ন বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তবে ইতিহাস হয়ত ভিন্ন বয়ান তৈরি করে নেবে। কত হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত, উদার মিশরীয়ই এই জেনারেলকে সর্বান্তকরণে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। আর এই জেনারেলই তাহরির স্কয়ারে নারী প্রতিবাদকারীদের কুমরিত্ব পরীক্ষায় বহু সময় খরচ করেছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে বুদ্ধিজীবীই সেনাবাহিনীকে গোপনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এসব বুদ্ধিজীবীকে ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো ঠিকঠাক মত বাস্তবায়ন করতে তাদের বুদ্ধি চেপে রাখতে হবে। অবশ্য প্রচলিত বিবদমান প্রশ্নগুলোতে দাঁড়ালে এর মানে কি রাজনৈতিক ইসলামের সমাপ্তি? বিশেষভাবে এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের জন্য আরো বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষায় সচেষ্ট হতে ব্রাদারহুডের কোন ভাবসাব দেখা যাচ্ছে না। গণতন্ত্র এখন যেন প্রত্যাখ্যাত, যেটি মিশরে এখনকার বিপদ হয়ে উঠল। স্বাধীনতার কথা বাদ দিলে মিশরে এ মুহূর্তে শুধুই সহিংসতা। তবে কি মিশর আরেকটি সিরিয়া হতে যাচ্ছে? অসম্ভব কিছু না।
পুরো আরব বিশ্বজুড়ে জনগণ যা চায় তা তাদের নেতারা চায় না। নিরীহ সাধারণরা জীবন দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে আজকে যার মৃত্যু হয়েছে তা হল একটি মতাদর্শের। যে আদর্শ মনে করে মিশর ছিল পুরো আরব জাতির চিরমাতা। জাতীয়তাবাদী এই আদর্শের মধ্যেই মিশর তার সকল জনগণকে নিজের সন্তান হিসেবে লালন করে। এমন কেউ নেই যে বলেছে, তারা ‘সন্ত্রাসী’, জনগণের শত্রু। পুলিশ এবং সরকারের সমর্থকদের পাশাপাশি আজকে ব্রাদারহুডের যারা খুনের শিকার হয়েছেন তারাও এই মিশর মাতারই সন্তান।
রবার্ট ফিস্ক, খ্যাতিমান সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ
সূত্র: দ্যা ইনডিপেনডেন্ট।