মিসরে নতুন করে সংঘর্ষে নিহত ৯৫, আহত কয়েকশ’

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন : মিসরে নতুন করে সহিংসতায় দুই সেনা সদস্যসহ কমপক্ষে ৯৫ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে। বুধবারের গণহত্যার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান বিরোধী জোটের আহবানে ‘ক্ষোভ দিবস’ পালনকালে কায়রোর রামসিস স্কয়ার, দামিয়েত্তা, অক্টোবর ৬ ব্রীজ, মে ১৫ ব্রীজ এলাকা এবং বন্দর নগরী ইসমাইলিয়ায় অভ্যুত্থান বিরোধীদের সাথে নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষকালে হতাহতের এসব ঘটনা ঘটে। এদিকে মিসরে গণহত্যার প্রতিবাদে সংসদে প্রস্তাব পাস করেছে পাকিস্তান এবং প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। বিবিসি/রয়টার্স/আল জাজিরা/রেডিও তেহরান।
সেনা সমর্থিত সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারি ও কড়া নিরাপত্তা বেস্টনি উপেক্ষা করে গতকাল শুক্রবার সারা মিসরে ‘ক্ষোভ দিবস’ পালন করেছে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান বিরোধী জোট। এদিকে ক্ষোভ দিবস মোকাবিলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের তরফ থেকে বিক্ষোভ প্রতিহতের ঘোষণা এবং সরকারি স্থাপনায় হামলা হলে গুলী করার নির্দেশ জারি করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কোথাও কোন সমাবেশ-অবস্থান সহ্য করা হবে না। কিন্তু সকল হুমকি উপেক্ষা করে জুমা নামাজের পর কায়রো , ইসমাইলিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, টান্টা, নাসর শহরের অসংখ্য মসজিদ থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ রাজপথে নেমে আসে এবং অভ্যুত্থানকে প্রত্যাখ্যান করে সেøাগান দিতে থাকে। বিশেষ করে কায়রোর নাসর সিটি এবং বন্দর নগরী ইসমাইলিয়ার রাজপথ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বুধবারের গণহত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার এই ‘ক্ষোভ দিবস’ পালনের ডাক দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা রামসিস স্কয়ারে বিশাল সমাবেশে মিলিত হয়। ব্রাদারহুড আগেরদিনই রামসিস স্কয়ারে অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ব্রাদারহুডের এই কর্মসূচি ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনী সকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক বন্ধ করে দিলেও গণমানুষের ঢল ঠেকাতে পারেনি। গণতন্ত্র পুণপ্রতিষ্ঠার দাবিতে লাখো জনতার ঢল নামে রামসিস স্কয়ারে।
আল জাজিরার সাথে সরাসরি কথা বলার সময় আহমেদ তোহামি নামের একজন বিক্ষোভকারী জানান, অক্টোবর ৬ ব্রীজ এলাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর টিয়ারগ্যাস ও গুলীবর্ষণ করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, মিছিলে অংশগ্রহণকারী বয়স্ক নারী-পুরুষ সহ সবার উপরে নির্বিচারে গুলী চালিয়েছে তারা।
রয়টার্স সংবাদদাতা জানান, বন্দরনগরী ইসমাইলিয়াতে নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয়।
আল জাজিরা সংবাদদাতা সিমন ম্যাকগ্রিগর উড জানিয়েছেন, টান্টা সিটিতে বিক্ষোভ ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর টিয়াসগ্যাস নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান বিরোধী জোটের আহবানে টান্টা সিটিতে কমপক্ষে ১০ হাজার নারী-পুরুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। জুমার নামাজের পর তারা বিক্ষোভ শুরু করলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের উপর টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তিনি আরো বলেন, মৃত্যুর হুমকি মাথায় নিয়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী টান্টা থেকে নাসর সিটি অভিমুখে এগিয়ে যায়।
মিসরে সামরিক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে কায়রোয় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছে তুরস্ক।
তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গতকাল শেষ বেলায় জানিয়েছেন, “মিসর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছি।”
এর আগে, গতকাল তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়্যেব জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মিসরের জনগণ শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছিল কিন্তু তাদের ওপর খুবই ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়েছে।
গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজ নীরব থাকায় তারও নিন্দা জানিয়েছেন এরদোগান।
পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ মিসরে রাজপথের বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্য সাহেবজাদা তারিকুল্লাহ উত্থাপিত এ প্রস্তাবে মিসরের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের প্রতি পাক সংসদ পুরো সমর্থন ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে নিরিহ ও নিরস্ত্র মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে পাক পররাষ্ট্র দফতরও নিরিহ মানুষদের ওপর মিশরিয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নিন্দা করেছে। পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে ১৪ আগস্টের রক্তক্ষয়কে মিসরের গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মিসরের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিসহ সব রাজবন্দিকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিসরে বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারি বাহিনীর নির্মম হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার জনগণ। তারা মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি মার্কিন সমর্থনেরও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় জুমার নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ মার্কিন দূতাবাসের সামনে সমবেত হয়ে মিসরীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছে। এ সময় তাদের হাতে ছিল নানা সেøাগান লেখা প্ল্যাকার্ড।
একই ইস্যুতে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরেও বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে একটি মসজিদের সামনে সমবেত হয়ে জনতা মিসরের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সেøাগান দেয়। সেখানেও জুমার নামাজের পরই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়।
মিসরে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভরত জনতার ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে এ পর্যন্ত বহু লোক নিহত হয়েছে। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের একটি সূত্র দাবি করেছে, বুধবারের হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে মিসরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মুরসি সমর্থকদের বিরুদ্ধে ওই অভিযানে ৬৩৮ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৩৭১৭ জন ।
এদিকে, বুধবারের এ গণহত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই বলেছেন, মিসরের নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যাকা- নিয়ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, কার্যকরি ও বিশ্বাসযোগ্য পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চালাতে হবে এবং দোষীদেরকে তার দায় নিতে হবে। এছাড়া, দেশটিতে নতুন করে যেকোনো সহিংসতা এড়ানোর জন্য তিনি দু’পক্ষের মাঝে সংলাপ অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button