শিশু বদল আর পরকীয়ার অপবাদ নিয়ে একটি পরিবারের যন্ত্রনা
মেহেদী হাসান: মাননের চেহারার সাথে তার পিতার কোন মিল নেই। সেজন্য মাননের পিতাকে এলাকার লোকজন বলত মানন আসলে তোমার মেয়ে নয়। তোমার বউয়ের সাথে অন্য পুরুষের সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে এলাকার পোস্টম্যানের সাথে তার গোপন সম্পর্ক রয়েছে এবং মানন আসলে পোস্টম্যানেরই মেয়ে। মাননকেও এলাকার লোকজন পোস্টম্যানের মেয়ে বলে ডাকত।
জঘন্য এ অভিযোগে খুবই অতিষ্ট হয়ে পড়ে মানন, তার বাবা-মা এবং পুরো পরিবার। মাননের মায়ের নাম সোফি সেরানোা। মাননের বাবা এক পর্যায়ে সোফিকে সন্দেহ করতে থাকে এবং তার বিশ্বাস জন্মে পোস্টম্যানের সাথে সত্যিই তার সম্পর্ক রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগের যন্ত্রনায় এক পর্যায়ে মাননের পিতৃত্ব পরীক্ষার প্রস্ততি নেন তার পিতা। সেটা ২০০২ সাল। মাননের বয়স তখন ৮ বছর। পিতৃত্ব পরীক্ষায় সত্যিই ধরা পড়ে মানন তার ঔরসজাত মেয়ে নয়। এরপর সোফিকে তালাক দেয় মাননের পিতা।
মাননকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয় সোফি। শুধু ঘর ছাড়তে হলে তো বাঁচত সে কিন্তু সাথে জুটে একরাশ কলঙ্ক। এ ঘটনায় মানন এবং সোফির ওপর দিয়ে ভীষন ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু সোফি তো জানে আসলে কোন পরপুরুষের সাথে তার সম্পর্ক নেই এবং মানন তার স্বামীরই ঔরসজাত মেয়ে। তাহলে এটা কি করে সম্ভব হল? পরীক্ষায় কেন রিপোর্ট আসল মানন তার স্বামীর ঔরসজাত নয়। সোফি এবার উদ্যোগ নেন মাননের মাতৃত্ব পরীক্ষা করার। পরীক্ষায় এবার যা ধরা পড়ল তা আরো বিস্ময়কর। মানন তারও গর্ভজাত মেয়ে নয়। তাহলে মানন কার মেয়ে? কার মেয়েকে সে এতদিন নিজের গর্ভজাত এবং স্বামীর ঔরসজাত সন্তান বলে লালন পালন করে আসছেন?
সোফি ঘটনাটি স্থানীয় প্রশাসনকে জানান। ২ বছর পর পুলিশ তাকে জানায় হাসপাতালে সে যে শিশুটির জন্ম দিয়েছিল সেটি আসলে অন্য আরেক মায়ের কাছে তুলে দেয়া হয়েছে। তার শিশুটি যে মায়ের কাছে দেয়া হয়েছে সেই মায়ের শিশুটি দেয়া হয়েছে তাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুলের কারনে এ অদল বদলের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনা জানার পর ভেঙ্গে পড়েন সোফি এবং মানন দুজনেই। সোফি এবার খুঁজে বের করে নিজের শিশুটি যে মায়ের কাছে দেয়া হয়েছিল তাকে। শিশু অদল বদল হওয়া দুই পরিবার নিজেদের খুঁজে বের করে পরষ্পর মিলিত হয়। সোফির গর্ভজাত মেয়েটির নাম মাথিলদে। তবে শিশু দুটি তাদের সত্যিকার মায়ের পরিচয় পেলেও তারা যে যেখানে বড় হয়েছে এবং এতদিন যাকে আসল মা বলে জেনে এসেছে সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেখানেই তারা রয়েছে । মায়েরাও এটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু তারা খুবই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে এ ঘটনা জানতে পেরে। এতদিন যাকে নিজের মেয়ে বলে জেনেছে সে আসলে তার মেয়ে নয়।
ঘটনাটি ফ্রান্সের। শিশু অদল বদল হওয়া দুই পরিবারের মত ফ্রান্সের অনেক লোক এ ঘটনায় মর্মাহত।
আসল পরিচয় নিশ্চিত হওয়া এবং দুই পরিবার মিলিত হবার পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় এর বিরুদ্ধে তারা মামলা করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের আদালত দুই পরিবারকে দেড় মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরনের নির্দেশ দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে মাতাল এক নার্সের কারনে শিশু অদল বদলের এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে।
কিভাবে শিশু অদল বদল হল সে বিষয়ে সোফি জানান, ১৯৯৪ সালের ৪ জুলাই ফ্রান্সের কানের লা বোক্কা ক্লিনিকে একটি কন্যা শিশুর জন্ম দেন তিনি। শিশুটি জন্মের পরপরই জন্ডিস ধরা পড়ে এবং পরদিন তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়। একই দিন আরো একটি জন্ডিস রোগের শিশুকে একই জায়গায় রাখা হয়। সোফি জানান, তার শিশুটিকে যখন ইনকিউবিটর থেকে ফেরত দেয়া হয় তখন তিনি দেখতে পান শিশুটির গায়ের রং একটু তামাটে যা আগে ছিলনা। সেজন্য তিনি তখন সন্দেহ করেন এটা হয়ত তার শিশু নয়। তখন নার্স তাকে জানায় ইনকিউবিটরে তাকে বাল্বের সাহায্যে হালকা অতি বেগুনি রশ্মির তাপ দেয়া হয়েছে যার কারনে গায়ের রং পরিবর্তন হয়েছে। এটাই হল তার শিশু।
সোফি জানান, এরপর তিনি আর এ নিয়ে কোন কথা বলেননি। তাদের কথা সত্য মেনে নিয়ে হাসপাতাল থেকে তিনি তার শিশু নিয়ে বাড়িতে চলে যান।
সোফির নিজের মেয়েটি যে মাকে দেয়া হয়েছে তাদের রিইউনিয়ন নামে ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ থেকে আগত। দুই পরিবারের ভাষা, সংস্কৃতিতে কোন মিল নেই।
সোফি জানান, ১০ বছর আগে ঘটনা জানার পর মনে হয়েছে আমার শরীরের একটা অংশ আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
২০০৪ সালে দুই পরিবার আইনী লড়াইয়ে নামার পর ১০ বছরের মাথায় তারা আদালতের মাধ্যমে কিছূ ক্ষতিপূরন পেল। তবে তাদের দাবি ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার।
দক্ষিন ফ্রান্সের গ্রাসে সিভিল কোর্ট মানন এবং মাথিলদে প্রত্যেকে তিন লাখ পাউন্ড করে ক্ষতিপূরনের নির্দেশে দিয়েছেন। মানন এবং মাথিলদের তিন মা-বাবার প্রত্যেকে ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড এবং মানন ও মাথিলদের অপর তিন ভাই বোনেরও প্রত্যেককে ৫০ হাজার পাউন্ড দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মাথিলদে যে মা-বাবার কাছে বড় হয়েছে তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের অনুরোধের কারনে আদালতের রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুনানী অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোফি এবং মানন জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের দোষ স্বীকার করেছে এবং আমরা আমাদের প্রকৃত পরিচয় পেয়েছি এতে আমরা খুসী।
মানন এবং মাথিলার বয়স এখন ২০। আর সোফির বয়স এখন ৩৮। ১৯৯৪ সালে সোফি ১৮ বছর বয়সে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
সোফি প্রমান করেছেন পোস্টম্যান বা অন্য কারো সাথে তার কোন গোপন সম্পর্ক ছিলনা। কিন্তু তবু সোফি এবং তার পূর্ব স্বামীর সাথে পুনরায় কোন যোগাযোগ হয়নি।