৮ ফাল্গুন : ২১ ফেব্রুয়ারি
শফি চাকলাদার: আমরা কেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি সেই ১৯৫২ সাল থেকে। তখন বঙ্গাব্দ ছিল ১৩৫৮-এর ৮ ফাল্গুন। আমার জিজ্ঞাসা আমরা কেন ১৩৫৮-এর বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন পালন করতে পারছি না। বাধাটা কোথায়? বলা হয় মাতৃভাষা দিবস। ফেব্রুয়ারি মাসটা কি মাতৃভাষা শব্দের সাথে যুক্ত নয়। মাতৃভাষা দিবস যদি বলা হয় তবে ফাল্গুন মাস স্বাভাবিকভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না। যেটা ফেব্রুয়ারি অবশ্যই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। হিসেব কষলে পাওয়া যায়, পাকিস্তান আমলে আমরা ১৯টি বছর একুশকে পেয়েছি এবং একুশ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত ছিল। পাকিস্তান থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। এবার ৪৪তম মাতৃভাষা দিবস পালন হচ্ছে। এখন তো পাকিস্তানি ভিনভাষীরা শাসন করছে না, পদে পদে আঘাত হানছে না, তবে কেন ৮ই ফাল্গুন স্বীকৃতি পেল না? এখন তো ক্ষমতায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশীরা। বাংলা একাডেমীই বা কি করছে। এই প্রতিষ্ঠানটিই কিন্তু এই প্রধান প্রধান একাধিক কাজগুলোর দায়িত্ব ঠিক ঠিকভাবে সমাপ্ত করতে পারত। যেমন প্রধান বিষয়ের মধ্যে বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু না করে ১ ফাল্গুন থেকে শুরু করতে পারত। এতে এমন কিছুর অন্তরায় তো দেখছি না। একটি ঘোষণা দিলেই সবকিছুর সমাধান হতো-বইমেলার উৎসুক দর্শক-পাঠকরা সেই অনুসারেই আসা-যাওয়া করত। অসুবিধা তো হবার নয়। হয়তো খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করাতে বলত, ভাই যেটা চলে আসছে। এমন যুক্তির বিপরীতে বলতে হয় পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ স্থায়িত্বে আসেনি? আরও একটি প্রধান বিষয় হচ্ছে ডিসেম্বর জানুয়ারি ইংরেজি মাসের প্রথম তারিখে বা প্রথম সপ্তাহে যে বেতন দেয়া হয় সেটা বাংলা মাসের প্রথম তারিখে কিংবা প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রচলন করার ঘোষণা দিলে কি কোন অন্তরায় সৃষ্টি হতো? মোটেও হতো না। যে সকল প্রতিষ্ঠান ইংরেজি মাসের নানান তারিখে বেতন-ভাতা দিয়ে থাকত সে সকল প্রতিষ্ঠান বাংলা মাসের নানান তারিখে বেতন-ভাতা প্রদান করবে, এতে অসুবিধা তো হবার কথা নয়? বাংলা একাডেমীই পারত, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে। হয়তো অনেকে কথা দাঁড় করাবেন বিরোধিতা করতে। কিন্তু একবার প্রচলিত হয়ে গেলে বিরোধকারীরা থেমে যেত। লাভ হতো বাংলা তারিখ গুণতে শিখত এবং বইমেলাতেও যাওয়া হতো বাংলা মাসের তারিখ গুণেই। বাংলাভাষা এবং বাংলা তারিখ নতুনভাবে তার নির্দিষ্ট স্থানে স্থান করে নিতো। উপকার হতো সকল বাংলাভাষীর। এটা লজ্জার বিষয় অবশ্যই যে, বাংলা তারিখটা ঐ বাংলার জন্য ক্রন্দনরত ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবীরাও জানে না। আর এরাই উপদেশ দেয় বাংলা নিয়ে। এদের চেনা মুখগুলো থেকে কখনও শোনা গেল না যে, বাংলা একাডেমীর বইমেলা কেন ১লা ফাল্গুন থেকে ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে পুরো ফাল্গুন মাসব্যাপী হওয়ার দাবি’র কথা। কিংবা বেতন-ভাতা বাংলা মাস অনুযায়ীর দাবি? কারণ আদর্শচ্যুত এই বুদ্ধিজীবীরা যতটা স্বার্থপর ততটা কাজ, তাই তাদের দ্বারা হবার নয়। তারা বলবে, তোমরা বাংলাদেশে থেকে দেশের সৌন্দর্য দেখ, বাংলায় কথা বল অথচ এদের ছেলেমেয়েরাই বিদেশে থেকে পড়ালেখা করছে, ডিগ্রি নিয়ে ফেরত এসে দেশের ক্রীম পোস্টগুলো দখল করে নিচ্ছে। লক্ষ্য করেছি, বাংলা এবং ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ৮ই ফাল্গুন ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবছর একই তারিখ হয় না। কখনো কখনো ২১ ফেব্রুয়ারি বরাবরের ন্যায় ৮ই ফাল্গুন না হয়ে ৯ হয় কখনো বা ৭ই ফাল্গুন হয়। বাংলা ৮ই ফাল্গুন পালিত হলে একই ধরনের হতেই পারে ৮ই ফাল্গুন কখনো ২০ ফেব্রুয়ারি কখনো ২২ ফেব্রুয়ারি হতেই পারে- এসব কখনোই সমস্যা তৈরি করে না। বাংলা পঞ্জিকাগুলোতে দেখি হিজরি মাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। হিজরি সন ৩৫৪ দিন চান্দ্র মাসের হিসেবে। ফলে চিহ্নিত দিনগুলো মিলছে না-১১ দিন কম হওয়ায় জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ দিবসগুলো ঠিক হিসেব করতে না পারায় এলোমেলো হয়ে যায়, কারণ যারা করছে তারা নিষ্ঠাবান নয়, সিনসিয়ার নয়। ১৯৮০’র দশকে Decca ইংরেজি বানান ঢাকা উচ্চারণে Dhaka করা হল কিন্তু এমন তো অনেক রয়েছে সেগুলো যেমনটা তেমনি রয়ে গেল-বাংলা উচ্চারণের সাথে ইংরেজি বানান ব্যবধান থেকেই গেল। যেমন: চট্টগ্রাম হবে Chattagram কিন্তু বৃটিশ সময় থেকে ইংরেজরা এর উচ্চারণ যেমন করতো তেমনি আজও হয়ে চলেছে- Chittagong. যশোহর হবে Jashohar কিন্তু হয়ে চলেছে Jessore, ময়মনসিংহ হবে Moimonsingha হয়ে চলেছে Mymensing, তেমনি Silet সিলেট হচ্ছে Sylhet, পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে Parbatta Chattagram হয়ে চলেছে Chittagong Hill Tracts. এমন আরও অসংখ্য রয়েছে বৃটিশ উচ্চারিত, সেগুলো বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪৩ বছর পরও তেমনটাই উচ্চারিত হয়ে আসছে। এটা কি লজ্জার এবং আফসোসের বিষয় নয়? বাংলা একাডেমী কি করছে? আমাদের বাংলা রক্ষাকারী বুদ্ধিজীবীরাই বা এ বিষয় নীরব কেন? তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তো রবীন্দ্র বলতে পাগল। সেই রবীন্দ্র যে বৃটিশ উচ্চারণ কে তাঁর দস্তখতে ব্যবহার করে ঠাকুর Thakur-কে Tagore করতেন, এটা পরিবর্তন অর্থাৎ ঠাকুরকে Thakur করা হলে কাছা দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়বেন না? অনেকে আল্লাহকে Allah-কে God বলে ইংরেজি করেন। তাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ লা শরীক আর God এর তো শরীক আছে- তো? ভগবানের ইংরেজি God মেনে নেয়া যায়, কিন্তু আল্লাহর ইংরেজি Allah এটা সকলেরই মনে রাখতে হবে।
যে কারণে ১৩৫৮-এর মাঘ-ফাল্গুনের দিবসগুলোয় যারা প্রাণ দিয়েছিল তার কতটুকুই বা ‘বাংলা’ হয়েছে? সাধারণ জীবন ধারায় লক্ষ্য করা যায়, নানান অবিমৃষ্যকারিতা এবং সেটাই যেন স্বাভাবিক। হুজুগী চিন্তাধারার কার্যক্রমের কারণে বাংলাকরণ করবার মানসিকতাকে যেন হ-য-ব-র-ল করে দিচ্ছে। সবকিছুকে ‘বাংলা’ করবার মানসিকতা হারিয়ে বাংলাদেশ এখন হয়ে উঠেছে ‘কসমোপলিটন’ শব্দ মত। আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে, কিন্তু কেন? কিম্ভুতকিমাকার অ-সুর কণ্ঠে ধারণ করে চিৎকার আর চিৎকার শ্রুতিকে করে তুলেছে অশ্রাব্য। যে যেমন পোশাক-আষাক পড়ে মঞ্চে উঠে ওয়েস্টার্ন সঙ্গীত-যন্ত্রগুলোকে দেদারসে পিটিয়ে বাংলার মাধুর্য-বৈশিষ্ট্যকে কাক-তাড়া করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত সবকিছুকে ‘বাংলা’করণের এই একটি রূপ প্রকাশ হয়ে গেছে। যে কোন অনুষ্ঠানে গেলে খাওয়ার টেবিলে উচ্চারিত হচ্ছে ‘ডিশ’টা দাও। ‘কারি’ দাও। ‘রাইস’ এদিকে। ইংরেজির আধিপত্যে এখন মামা, চাচা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘আঙ্কল’। অর্থাৎ সকলের অজান্তে সকলের সামনে দিয়েই ‘বাংলা’ করণের উচ্ছৃঙ্খলতার ফাঁক দিয়ে ‘ইংরেজি’করণ স্থান করে ঢুকে পড়ছে। যদি বাংলা তারিখ বাংলা মাস এবং বেতন-ভাতা বাংলা মাস মাধ্যমে কার্যকর হতো তবে এই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামলে দেয়া যেত। আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির জন্য একুশ রাখতে হবে এমন ভঙ্গুর কল্পনার প্রশ্রয় কেন? প্রয়োজনে নতুন গান ৮ই ফাল্গুন কেন্দ্রিক হবে এবং তবেই তো ভাষা দিবসের মর্যাদা আসবে। এটা এখন সকলের লক্ষ্যে এসেছে যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে যিনি সাক্ষাৎ দিচ্ছেন এবং উপস্থাপক-উপস্থাপিকা যেন ইংরেজি বলতে পারলেই ঠিক হচ্ছে মনে করেন। ‘কসমোপলিটন’ বা ‘মিশ্র’তা মিশিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আদর্শেও মিশ্রতা দেখা যাচ্ছে। ধরুন একজন মানুষ চলছেন পথে- দেখতে পেলেন পূজা হচ্ছে দাঁড়িয়ে গেলেন ঐ পূজা দেখতে, ভাবলেন, আহা আমি যদি এদের একজন হতাম। আবার যেতে লাগলেন দেখছেন অনুষ্ঠান হচ্ছে, বৌদ্ধ অনুষ্ঠান হচ্ছে-ভাবলেন আহা আমি যদি এদের একজন হতাম। আবার যেতে লাগলেন, অনুষ্ঠান দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, খৃস্ট অনুষ্ঠান-ভাবলেন আহা আমি যদি এদের একজন হতাম। এসব করে করে নিজের ‘সালাত’টাই পড়তে পারল না-। আবার ভাবছে, বাঙালি না বাংলাদেশী। বাংলাদেশ যখন দেশের নাম তখন বাংলাদেশী তো হওয়া স্বাভাবিক। তাহলে ‘বাঙালি’ কি হবে? ‘কসমোপলিটন’-এর বাংলা মিশ্র হোক বা না হোক ‘খিচুড়ি’ বললেই বা কি হয়। আমরা এখন এমন আদর্শের মানুষ হয়ে কখনো কখনো হোঁচট খাচ্ছি। অগ্রসরে বাধা পড়ছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আজ চুয়াল্লিশতম ভাষা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে অথচ আজও বাংলা তারিখ প্রাধান্য পেল না। যে কোন কাজ তা সরকারি কি বেসরকারি হোক তাকে বিম্বিত করা হয় ইংরেজি তারিখ দিয়ে। যদিও ১৯৮৪ (?)তে বাংলা সন গ্রহণীয় হয় সেখানেও কিন্তু থেকে গেল। মুঘল স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রচলিত বঙ্গাব্দকে গ্রহণ না করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক প্রণীত বঙ্গাব্দ গ্রহণ করা হল। ডক্টর সাহেব যেটা করেছিলেন তাতে বঙ্গাব্দের বৈচিত্রীয় ধারাটি থাকল না- অর্থাৎ ২৯ থেকে ৩২ দিনে মাসকে পরিবর্তন করে করা হলো প্রথম পাঁচটি মাস গুণতে হবে ৩১ দিনে পরবর্তী সাতটি মাস ৩০ দিনে। অধিবর্ষ থাকবে তবে সেটাও হবে ইংরেজি অধিবর্ষতে। ২০১৬ ইংরেজি অধিবর্ষ ফেব্রুয়ারি হবে ২৯ দিনে। এবং এই বছরের এই মাসেই বাংলা অধিবর্ষের তারিখ গুণতে হবে। অথবা সে সময় বাংলা সালের ১৪২২ চার দিয়ে বিভাজ্য হয় কি? ইংরেজি গুণতে হবে। অথচ সে সময় বাংলা সালের ১৪২২ চার দিয়ে বিভাজ্য হয়কি? ইংরেজি অধিবর্ষর সাথে তাল মিলিয়ে এমন অধিবর্ষর গণনা যুক্তিসঙ্গত কি ? যাই হোক গ্রাম-অঞ্চলে এখনো আকবরী বঙ্গাব্দতেই হালখাতা, নববর্ষ দিনগুলো প্রচলিত হয়ে চলেছে। ড. শহীদুল্লাহ যেটা করেছেন সেটা হচ্ছে শহরাঞ্চলের শিক্ষিত সমাজকে লক্ষ্য করে। এই তথাকথিত মাইনরিটি শিক্ষিত সমাজ-এর মানুষেরা বঙ্গাব্দের কোন মাস ২৯ বা কোন মাস ৩২ দিনে সেটা জেনে রাখতে কষ্টদায়ক বিধায় বঙ্গাব্দ’র দিনগোণাকে সহজ করা হল। তবুও তা গ্রহণীয় হলো না- না শহরে না গ্রামে-গঞ্জে। আর তথাকথিত এই সংখ্যালঘু শিক্ষিত সমাজকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকার এই বিভ্রান্তির স্বীকৃতি দিলেন সরকারি ক্যালেন্ডারে স্থান দিয়ে। এরপরও বাংলা তারিখ ঐ সংখ্যালঘু শিক্ষিত সমাজ অনুসরণ করছে না। তারা করছে ইংরেজি তারিখ বরাবরের ন্যায়। তাই আকবরী বাংলা দিনপঞ্জী গ্রহণ করাটাই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। পঞ্জিকাগুলোতে এখন দুটো বাংলা তারিখ ফলো করে আসছে ঐ থেকে। তবে বঙ্গাব্দকে দৈনন্দিন উচ্চারণে আনতে হলে চাই সিনসিয়ার বাস্তববাদী পদক্ষেপ। যেমন সরকারি দিনপঞ্জীকে ঘিরে। অর্থাৎ বর্তমানে ইংরেজি খ্রিস্টাব্দ থাকছে প্রধান হিসেবে সেখানে বঙ্গাব্দ হবে প্রধান দিনপঞ্জী। শুধু তাই নয় দিনপঞ্জী ছাপাতে হবে বৈশাখ থেকে এবং ইংরেজি তারিখ থাকবে ধর্মীয় মাস হিজরী সালের সাথে এটাই হওয়া দরকার সরকারি দিনপঞ্জীতে। এবং সরকারি, আধাসরকারি, ব্যক্তি মালিকানাধীনসহ সকল প্রতিষ্ঠানে বেতন হবে বাংলা মাস হিসেবে এবং এমন প্রচলন ধারার নির্দেশ হলেই ‘বাংলা’ তার প্রাপ্য স্থান দখল করতে পারবে ইনশাল্লাহ। নচেৎ নয়। অন্যথায় বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ক্রমান্বয়ে হয়ে দাঁড়াবে ‘বাংলিশ’ ভাষা যার সূত্রপাত ইতোমধ্যেই ঐ তথাকথিত বাংলা-প্রিয়দের দ্বারা প্রচলিত হয়ে গেছে- যারা ১ লা বৈশাখ খোঁজে ইংরেজি তারিখ দেখে।
প্রসঙ্গক্রমে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে বাংলা ভাষা নয় বাংলা সুর নিতে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রতেই লক্ষ্য করা যাক। সঙ্গীত এমন একটি মাধ্যম যা অতিদ্রুত জন থেকে জনে বিস্তৃতি ঘটায়। বাংলার সুরে ‘সুমধুর’ বা ‘মাধুর্য’ আজ নেই- পালিয়েছে। দখল করে নিচ্ছে অসুর মাত্রিক বেসুরো সঙ্গীত। দেখতে পাবেন পারফরমেন্সের নামে বেলেল্লাপনা। চিৎকার যে যতটা সম্ভব ত্রাহি রবে অদ্ভূত শারীরিক কসরৎ নৃত্যযোগে পরিবেশন করা হয়। এটাকে বলা হয় ওয়েস্টার্ন ঢং-এর বঙ্গীয় সঙ্গীত। এরা উৎসাহও পাচ্ছে বেসরকারি তো বটেই সরকারি চ্যানেলেও। যন্ত্রীরা পর্যন্ত নানান অঙ্গ-ভঙ্গিমায় ব্যস্ত রাখে নিজেদেরকে। সঙ্গীতের ভাষা বা বাণী একরকম হলেই হলো। পশ্চিমা সুর-অসুর এখন বাঙ্গালিদের কবজায়। যাবে কোথায়? আরো একটি বিষয় মন্ডে এই ত্রাহি সঙ্গীতের শুরুতেই উপস্থিত তরুণ প্রজন্মের বৃহৎ অংশের যেভাবে নর্তন-কুর্দন এ মেতে উঠে তখন মনে হয় দেশ থেকে ‘লজ্জা’ শব্দটিকে অভিধানেই রাখতে চাচ্ছে না ওরা। এই নতুন প্রজন্ম এবং ধনীক শ্রেণি যারা নিজেদের মনে করে এ্যারিস্টোক্র্যাট-নজরুলের ভাষায় ‘আড়স্ট-কাক’ তারা ইংরেজি ছাড়া বাক্য সম্পূর্ণ করতেই চায় না।
আর এই নতুন রোগের নিরাময়ে ডাক্তার না পাওয়ার (?) কারণে চ্যানেলগুলো উৎসাহ পাচ্ছে। হয়তো নতুন একাভাষার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যার নাম সম্ভবত বাংলিশ আর গ্রাম-মফস্বলের ভাষা যথারীতি থাকবে বাংলা। অর্থাৎ দশভাগ ধনী ও নতুন প্রজন্ম এবং নব্বই ভাগ মফস্বলের মানুষ নিয়ে হবে এর বিভাজন। তবে দশ ভাগ যেহেতু + শহুরে + নতুন প্রজন্ম এবং এই দলটির শক্তি বেশি হওয়ার কারণে বাংলিশই হবে অফিস আদালতের ভাষা? এমন পরিস্থিতিকে এ্যাডভান্টেজ না দিয়ে আগেভাগেই এর বিনষ্ট অঙ্কুরেই করা দরকার, নয় কি? কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থাকে- কে এর বিনষ্ট করবে? এর চর্চাকারীরাইতো প্রতিটি নিয়ন্ত্রণ স্থানে বসে আছে? ভবিষ্যতে কি হবে এই বাংলা ভাষার? ৮ই ফালগুন তো তাই আগেভাগেই একুশের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে বসে আছে। আজকাল রান্নাঘর এই সমাজটা বলতে নিজেদেরকে ‘ক্ষেত’ মনে করে। তাই ‘কিচেন’ এসে স্থান দখল করেছে। গোসল-খানা ভয়তে টয়লেট ফ্লাশ দিয়ে নর্দমায় গা ঢাকা দিয়েছে। পায়খানা তো বলাই যাবে না। নজুল তাই আগে-ভাগেই মাঝে মধ্যে ‘যায়খানা’ বলতেন। রান্নাঘর শব্দটি একাই কিচেন-এর কাছে আত্মাহুতি দেয়নি সাথে ডিশ, স্পুন, ইত্যাদিও উচ্চারিত হয়ে চলেছে।
যারা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হলেন- আবুল বরকত, শফিকুর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, রফিকুল ইসলামসহ নাম না জানা আরো অনেকের প্রতি জাতি কি দিয়েছে তার পরিমাণই বা কতটুকু প্রতিদানে? ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেরই নামে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের নামকরণে শোভা পাচ্ছে। অথচ যারা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে স্থায়িত্ব দিলেন, বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিলেন সেই ভাষা শহীদদের জন্য জাতির করণীয় কাজ যেন সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। তাদের প্রতি যা করণীয় তা যেন অতি তুচ্ছ। অনেক কিছুই তাদের প্রতিদান হিসেবে দেয়া যেতে পারে। তাদের প্রত্যেকের নামে জাতীয় পুরস্কার ঘোষণা করা যেতে পারে। প্রতিবছর দিবসটি এলেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করা হয়। পরিস্কার করা হয় কেন- সারা বছর পবিত্র-পরিস্কার থাকছে না কেন? জুতো পায়ে যেতে অসুবিধের কারণটাই বা কি? পার্শ্ববর্তী দেয়ালে বিভিন্ন গুণীজনদের বাণী শোভিত হয় অস্থায়ী। সারা বছরই পড়ে থাকে অবহেলায়, অনাদরে। ফলে প্রতি বছরই নতুন করে লিখতে হয়। মূল শহীদ মিনার চত্বরটি পড়ে থাকে অবহেলায়। দিবস এলে পরিস্কার হয়। তাই বলছি এমন একটা পরিকল্পনা নেয়া দরকার যাতে এই শহীদ মিনার চত্বরসহ চারদিকটা আকর্ষণীয় সজ্জায় ঘিরে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য থাকবে প্রহরী। শুধু তাই নয় শহীদ মিনারের গা ঘেঁষে মেডিকেল কলেজের দিকটায় একটা লাইব্রেরি করা দরকার লাইব্রেরিয়ানসহ এবং দেয়ালে শহীদ মিনারের অপরদিকে যে গুণী ব্যক্তিদের বাণী লেখা হয় তাও স্থায়ীভাবে লেখার পরিকল্পনা দরকার। মূল শহীদ মিনারের সামনের প্রাঙ্গণকে বা চত্বরকে ভাষা আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাদের নামে কটা ভাগে ভাগ করে নামকরণ করা যেতে পারে। যেমন বরকত চত্বর, সালাম চত্বর, শফিক চত্বর, রফিক চত্বর, জব্বার চত্বর। প্রতিটি চত্বরে নাম অনুযায়ী নাম ফলক থাকবে যাতে ছবি এবং সংক্ষিপ্ত জীবনী থাকবে। চত্বরগুলোয় বিভাজন রেখা পায়ে চলার পথ-মত করে করা যেতে পারে। এতে করে সারা বছরই শহীদ মিনার অঙ্গনটি পরিপাটি থাকবে এবং দর্শনকারীদেরও আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। পবিত্রতাও বৃদ্ধি পাবে। প্রহরীও থাকবে।
বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ ভূমিকা জাতিকে শিখিয়েছে আদর্শ, জাতীয়তাবোধ। ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষীদের শিক্ষা দিয়েছে সত্যকে মাথা উঁচু করে বলতে। মিথ্যার বিরুদ্ধে কুটনামির বিরুদ্ধে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করতে শিক্ষা দেয় বাংলা ভাষা আন্দোলন। বাংলাদেশের বাঙালিরা সত্য বলতে পারে এবং তা বিশ্বকে দেখিয়েছেও। জয় করেছে সত্য বলেই। তাই বাংলাদেশের সকল প্রচার মাধ্যম যেসব তথ্য- ইতিহাস প্রচারিত হবে তাও যেন হয় সত্যের উপর ভিত্তি করে। চাণক্য আমাদের আদর্শ নয় আমাদের আদর্শ নজরুল। নজরুলের মত জাতি যেন বলতে পারে- “বিদ্রোহ মানে কাউকে না-মানা নয়, বিদ্রোহ মানে যেটা বুঝি না, সেটাকে মাথা উঁচু করে ‘বুঝি না’ বলা। আমরা এই ভাষা দিয়ে যেন নজরুলের বাণীকে জাতির কাছে পৌঁছে দিতে পারি- “ রাজতন্ত্র, স্বেচ্ছাতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মজাই হইতেছে এই যে, কর্তারা কেবল নিজের দিকটাই দেখেন। নিজেদের সুখ-সুবিধাটাই তাঁহাদের লক্ষ্য- বাকি সব চুলোয় যাক, তাঁহাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নাই।” ১৩৫৮ সনের আন্দোলন যে আদর্শে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আজ সে উদ্দেশ্য- আদর্শ সে ভাবে কাজ করছে না বলেই আমরা গোসলখানা বা স্নান ঘরকে বলছি বাথরুম-টয়লেট। অনুষ্ঠানে বলছি রাইস, ডিশ, স্পুন। ইংরেজি ছাড়া টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকার হয় না। পশ্চিমা সঙ্গীত তরুণ প্রজন্মদের সঙ্গীত (অ-সুর লম্ফ সঙ্গীত)। চাচা-মামা স্থলে এক ইংরেজি শব্দ আঙ্কল দ্বারা সম্বোধন হয়। অনেকে বলেন এসব কিছু না। আমি বলব এসবই কিছু। ইংরেজি ঢং যতটুকু এসেছে আর যেন অগ্রসর না হয় এসব জরুরি ভিত্তিতে থামিয়ে দিতে হবে। আমাদের বেতন বাংলা মাস অনুযায়ী হলে, আমরা ৮ই ফালগুনকে স্বীকৃতি দিলে, আমরা বাংলা একাডেমির বই মেলা ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ফালগুন মাসকে বাস্তবে রূপায়িত দেখলে অবশ্যই ‘বাংলা’ হয়ে উঠত আরো মধুর। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি ধার করে তৈরি হয়, কখনো সঠিক বুদ্ধি তাদের থেকে তাই আসে না। আদর্শ এদের নেই বলে জাতিকে, বাংলাভাষাকে তারা আজ অবহেলা করতে শিখিয়েছে। সাহিত্য যে ভাষা দিয়ে তৈরি সে ভাষার নির্মাতাদের ধনী এবং দরিদ্র দুটি ভাগে বিভক্ত করে না দেখা হয়। যা বিভেদ সৃষ্টি করে সুযোগ করে দিচ্ছে ধনী সাহিত্যিকদের। এমনটা পরিহার হলেই বাংলাভাষার তাঁর স্থান সঠিক পথে অগ্রসর হবে।