ভাষা আন্দোলনে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

Ibrahim Khaমামুন তরফদার: প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ যেমনি সাহিত্যে ও শিক্ষায় অবদান রেখেছেন, তেমনি বাংলাভাষা আন্দোলনেও গুরুতপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৬ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বঙ্গীয় আইন পরিষদে বাংলাভাষায় বক্তৃতা করেন, যা ছিল তৎকালীন ভারতে কোন নেটিভের সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় ব্রিটিশদের সঙ্গে কথা বলা। বাংলাভাষা আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম। তিনি ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। বাংলাভাষা বা ভাষা আন্দোলনের প্রতি প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর যে আকর্ষণ তা ছিল স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি ভালোবাসার অংশবিশেষ। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তার গভীর ভালোবাসার মধ্যে ছিল এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ। এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই তিনি বাংলাভাষা আন্দোলনে শরীক হন।
বাংলার কবি, সাহিত্যক, সাংবাদিক ও গীতিকারগণ তাদের লেখনিশক্তি দিয়ে বাংলাভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এ বিষয়ে ভাষা আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত অধ্যাপক আবুল কাশেমের ভাষায়- ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, আবুল মনছুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কবি তালিম হোসেন এবং আরো বহু নামকরা চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকবৃন্দ এর সঙ্গে নানা সূত্রে জড়িত এবং এর সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সহযোগিতা করেছিলেন, সহযোগিতা করেছিলেন বিশিষ্ট কর্মী আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, তদানিন্তন মুসলিম ছ্ত্রালীগের আহবায়ক নইমুদ্দিন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ সম্পাদক অলি আহাদ প্রমুখ কর্মী মজলিসের সাথে ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।’
ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ আব্দুল গফুর বলেন, ‘প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ৪৭ পরবর্তী জীবন প্রধানত ঢাকায় কাটে বলে তমদ্দুন মজলিসের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে আমরা তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা পুরোপুরি লাভ করি। আসলে তিনি ছিলেন সংগঠনমনা লোক। আমার যত দূর মনে পড়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরিচয় পরিষদ বা পরিচয় মজলিস নামের একটা স্বল্পায়ু সাংস্কৃতিক সংস্থা তিনি গঠন করেন, যার সাথে অধ্যাপক হাসান জামানও জড়িত হন। তমদ্দুন মজলিসের নানা কাজে, কখনও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের পক্ষ থেকে, কখনও নিজের থেকেই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতাম। ভাষা আন্দোলনসহ মজলিসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে তাঁর আন্তরিক সহযোগিতা লাভে আমরা কখনও বিফল মনোরথ হয়েছি বলে মনে পড়ে না। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার কার্জন হলে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে চার দিনব্যাপি যে ইসলামি সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ আর আমি ছিলাম সম্পাদক। আমি সার্বক্ষণিক অবস্থায় দেখেছি বাংলা সাহিত্যের প্রতি ইবরাহীম খাঁ ছিলেন আজন্ম দরদি সাধক। তার বিশাল কর্মময় জীবনে একজন দক্ষ ও নিপুণ শিল্পীর ন্যায় বাংলাভাষা, বাংলা বর্ণমালা, বাংলা বানান সর্বোপরি মাতৃভাষার উন্নয়নে তার কর্ম-উদ্যোগ ছিল অত্যন্ত ব্যাপক।
১৯৪৭ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে যে সব সভা সমাবেশ হয়েছে সে সবের প্রতিটিতেই প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর  প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। ইবরাহীম খাঁ তখন থেকেই উক্ত সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকে নানা বিষয়ে বুদ্ধি ও পরামর্শ প্রদান করেছেন। বিশেষ করে তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শগুলো ভাষা-আন্দোলনের গতি সঞ্চারে  খুবই সহয়ক ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ও ঘোষণাপত্র ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। ওই দিন বিকাল ৪ টায় তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস ‘নুপুর ভিলায়’ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু করা হোক’ শীর্ষক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এটা ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সেমিনার। উক্ত সেমিনারে ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্রের ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ উক্ত সেমিনারে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন এবং আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র গ্রন্থের সম্পাদক রতন লাল চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বাংলাভাষার পক্ষে যে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা তথ্য, যুক্তি ও স্বদেশ প্রেমের এক অনন্য উদাহরণ।’
সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় আহ্বায়ক শামসুল আলম এর ভাষায়- ‘অকল্পনীয় পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় বেশ কিছু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে পূর্ব পাক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট ১৭ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে স্মারকলিপিটি পেশ করা হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক। উক্ত স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন- (১) মওলানা আকরম খাঁ (২) প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ (৩) আজাদ সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন (৪) কবি জসিম উদ্দিন (৫) আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (৬) সঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহম্মদ (৭) শিল্পী জয়নুল আবেদীন (৮) সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ (৯) কাজী আফসার উদ্দিন আহমেদ (১০) সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও প্রধান উদ্যোক্তা অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং আরো অনেকে।’ এখানে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রভাষার জন্য স্মারকলিপিটিতে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর স্বাক্ষর দুই নম্বরে রয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন সরকার আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে ৮ দফা রাষ্ট্রভাষা চুক্তি করতে বাধ্য হয়। জরুরী ভিত্তিতে এই চুক্তি কার্যকর করার জন্য দেশের সকল পেশা ও শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করা হয় এবং সরকারের নিকট তখনকার সময়ে গ্রহণযোগ্য ও পন্ডিতদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে একটি মীমাংসার উদ্যোগ নেয়া হয়। উক্ত স্মারকলিপি প্রস্তুতকারী, স্বাক্ষরদাতা এবং প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৮ সালের ৭ মে ভোলার শুকদেব মদনমোহন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাখরগঞ্জ জেলা শিক্ষক সমিতির উনত্রিশতম অধিবেশনে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বাংলাভাষা সম্পর্কে বলেন, ‘মায়ের দুধে ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ে, কারণ অতি সহজে সে তা হজম করে আত্মস্থ করতে পারে; তোলা দুধ অনেক সময়ই বদহজম হয়- ছেলে রিকেটি হয়ে পড়ে। তেমনি বাংলার ছেলে বাংলার মাধ্যমেই যা শিখতে পারবে তাতে যত সহজে তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে বাইরের কোন ভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভব নয়। পরদেশি ভাষা দিয়ে মাতৃভাষাকে স্থায়ীভাবে জয় করা দুনিয়ার ইতিহাসে কোন দেশে কোন যুগে সম্ভব হয় নাই।’
১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি উক্ত প্রতিনিধি দল পূর্ব পাক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সাথে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রভাষা চুক্তি কার্যকর করার জন্য তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নরূপ: ‘ড. মুুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ড. কাজী মোতাহের হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত এক প্রতিনিধি দল ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটায় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাভাষাকে অবিলম্বে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করার দাবিতে অধ্যাপক, এম.এল.এ, এম.সি.এ, সরকারি কর্মচারী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, প্রকাশক ও ছাত্রদের স্বাক্ষরযুক্ত এক স্মারকলিপি পেশ করেন।
উপরোক্ত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে গমনকারীদের অন্যতম প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ কিছুদিনের মধ্যেই মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে বাংলাভাষা চালু করার নির্দেশ দেন। এ সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন এ রকম- ‘বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেল, পূর্ব-বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ উক্ত পরিষদের দফতরের অভ্যন্তরে বাংলাভাষা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। পূর্ব বাংলার মধ্যে এই দফতরেই বাংলাভাষা ব্যবহারের সুযোগ সর্বপ্রথম দেয়া হল।’ স্মারকলিপিতে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড বাংলা এবং ইংরেজিতে নোট লিখিবার জন্য শিঘ্রই নির্দেশ দিবেন বলিয়া জানান।
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ভাষা আন্দোলনের জন্য অর্থ দান করেও অবদান রেখেছেন। তার প্রমাণ ভাষা কন্যা সুফিয়া আহমেদ এর ভাষায় পাওয়া যায়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কুদরতে খুদা, ইবরাহীম খাঁ সাহেব, জাস্টিস ইমাম হোসেন চৌধুরী, জাস্টিস রাধিকা রঞ্জন গুহ চাঁদা দিয়েছিলেন’।
তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের সচিব এফ.এ. করিম ছিলেন উর্দুভাষী। তিনি ও তাঁর সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্দু বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু ইবরাহীম খাঁ শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাছাড়াও প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বহুবার পূর্ব পাকিস্তানের অফিস, আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা ব্যবহার ও চালুর জন্য নানা উদ্যোগ, চেষ্টা ও তদবির করেন। উক্ত বিষয়ে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর বক্তব্য এরকম- ‘একবার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনকে অনুরোধ করলাম, পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি অফিসগুলির কাজ বাংলাভাষার মাধ্যমে চালু করুন। তিনি খানিকটা বিরুক্তির সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আপনি তো এক সরাজ দপ্তরের কর্তা। আপনার অফিসেই প্রস্তাবটা কার্যকরি করে দেখুন না।’ ‘আমি আমার অফিসে এ কাজ চালাতে চেষ্টা করলাম। কিছুদিন চলল তারপর চারদিকের বিরূপ চাপে এ প্রচেষ্টার মৃত্যু ঘটল।’ শত বিরূপ পরিবেশ সত্ত্বেও তিনি তাঁর অফিসে বাংলাভাষাকে অফিসের ভাষার মর্যাদা প্রদান করেন। এতে তিনি সরকারের বিরাগভাজন ও নিগৃহীত হন। তবু বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে অনঢ় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনায় তিনি খুবই মর্মাহত হন। হত্যাকান্ডের খবর শুনে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ হাসপাতালে ছুটে যান এবং আহত ছাত্রদের শুশ্রুষা করতে থাকেন। নিহতদের মরদেহ দেখে এবং আহতদের আর্তচিৎকার শুনে তিনি খুবই ব্যথিত হন। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ জানাতে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি সরাসরি নূরুল আমিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে হাসপাতালে গিয়ে ছাত্রদের কাছে ভুল ও অন্যায় স্বীকার করার জন্য দাবি জানান। তাছাড়াও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হোসেনের সাথে দেখা করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানান। বাংলাভাষা আন্দোলনের সফলতার পূর্বে এই আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সংগঠনমূলক কার্যক্রমে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা আন্দোলনের সাংবিধানিক বিজয়ের পরও এ লক্ষেই তিনি মাতৃভাষা বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে ‘বাঙলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়েছিলেন। বাঙলা কলেজ পরিচালনার জন্য যে পরিচালনা কমিটি গঠিত হয় তার সভাপতি ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আর সেক্রেটারী ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। বাংলাভাষা ও ব্যাকরণ সহজ করার জন্য ইবরাহীম খাঁ যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি হিসেবে সর্বপ্রথম বাংলাভাষাকে অফিসের ভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন। তখন তার বিরূদ্ধে তীব্র সমালোচনা হয়। এ রকম ভাষা আন্দোলনে ও বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠায় প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর আরো বহু উদাহরণ রয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের জনক অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়েছে বলে জানা নাই। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাদের ইতিহাস রচনায় যুক্ত করা হয় নাই। যারা ইতিহাস প্রণয়নের বস্তুনিষ্ঠ নীতি অনুসরণ না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে পক্ষপাতিত্বে প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে হয়। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের সময়ে পাকিস্তান সরকারের স্বারাষ্ট্র বিভাগের ও গোয়েন্দা বিভাগের ভাষা সম্বন্ধীয় ফাইল ও নোট গবেষণা করে এবং ১৯৪৭ সন থেকে ১৯৫২ সন পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলাদেশের সব দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকা এবং ১৯৪৭-৪৮ সালে কলিকাতার ইত্তেহাদ পত্রিকার প্রকাশিত আন্দোলন সম্বন্ধীয় লেখাগুলোও ইতিহাস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে আমার ধারণা।’
ভাষা সৈনিকদের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে ভাষা আন্দোলনের একটি নিরপেক্ষ তথ্য নির্ভর পূর্ণাঙ্গ বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী প্রকৃত ইতিহাস প্রণয়েনর দাবীই উচ্চকিত হয়েছে। আমরা এ বিষয়টির প্রতি নেক নজর রাখবো।
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নেতৃত্বে বাংলাভাষা সংস্কার আন্দোলনে বিবৃতি, সভা, সমাবেশ অংশগ্রহণসহ সাংগাঠনিক কাজে সক্রিয়ভাবে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষার ওপর সংস্কৃত ভাষার অনর্থক শব্দকে বাদ দিয়ে বাংলাভাষা ও ব্যকরণকে সহজ ও সরলীকরণ করতে গণ মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন। ভাষা-আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। বাংলাভাষা ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সহায়ক গ্রন্থ :
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস – মোহাম্মদ হান্নান।
ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছরপূর্তি স্মারক – সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম।
ভাষা আন্দোলন ৪৭ থেকে ৫২ – মোস্তফা কামাল সম্পাদিত।
ভাষা আন্দোলনের ডাইরী – মোস্তফা কামাল।
একুশের স্মারকগ্রন্থ – ৮৬ – সম্পাদনা পরিষদ, বাংলা একাডেমী।
বাংলাদেশের ইতিহাস – প্রথম খ- – সম্পাদক – সিরাজুল ইসলাম।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস – আবুল কাশেম।
ময়মনসিংহ চরিতাভিধান – দরজী আবদুল ওয়াহাব।
ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্তী।
একুশে ফেব্রুয়ারি – হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত।
চল্লিশ থেকে একাত্তর – এম.আর. আখতার মুকুল।
ভাষা আন্দোলনের প্রসংগ কতিপয় দলিল – বদরুদ্দীন উমর।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস – বশীর আল হেলাল।
অমর একুশে – হায়াৎ মামুদ।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি – বদর উদ্দিন উমর।
ফালগুণী সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যা – ২০০২ – সম্পাদক ফেরদৌস সালাম।
স্মরণিকা দ্যুতি তৃতীয় খ- – আসাদুজ্জামান খান সম্পাদিত।
সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১।
আমি ইবরাহীম খাঁ বলছি – ড. এ.এস.এম. আজিজুল্লাহ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে টাঙ্গাইল – মামুন তরফদার।
সম্প্রতিক ভাষা সংখ্যা – ২০১২ – সম্পাদক আমিরুল বাসার।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button