উলামায়ে হক সমীপে
সমরখন্দে সমাহিত তৈমুর বেগকে ইতিহাসে আমির তৈমুর ও তৈমুর লং নামেও স্মরণ করা হয়। গোটা বিশ্ব জয় করার বাসনা নিয়ে তৈমুর লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছেন। তিনি মানুষের মাথার খুলির মিনার বানিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতেন। তৈমুরের এক পা ল্যাংড়া ছিল। তবে তিনি দু’হাত দিয়ে তরবারি পরিচালনায় বেশ দক্ষ ছিলেন। পবিত্র কুরআনের হাফেজও ছিলেন। সমকালীন বড় বড় মুফতিয়ে কেরামের সাথে ফিকহে ইসলামি নিয়ে আলোচনার আগ্রহও ছিল বেশ। তিনি নিজেকে ইসলামের সাচ্চা মুজাহিদ মনে করতেন। অথচ তিনি বাগদাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধ জয়ের পর মুসলমান নারী-শিশুকে হত্যা করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ তুঘলককে পরাজিত করার পর তৈমুর শুধু দিল্লিতেই এক লাখের বেশি যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করেন। একবার তৈমুর সারা বিশ্ব থেকে নামকরা উলামায়ে কেরামকে দামেশকে ডেকে বললেন, কুরআন পাকের আয়াতের ধারাবাহিকতা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আছে কি? এ প্রশ্ন উলামায়ে কেরামকে হতভম্ব করে দিলো। তৈমুর বললেন, কুরআনের আয়াতকে বিষয়ভিত্তিকের আলোকে নতুনভাবে সাজানো যেতে পারে নাকি; আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যে ধারাবাহিকতায় নাজিল হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় সাজানো যেতে পারে? তৈমুরের প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনোবাসনা উলামায়ে কেরাম বেশ বুঝে ফেললেন। তারা তৈমুরের কাছে চিন্তাভাবনার জন্য সময় চাইলেন। উলামায়ে কেরাম পরস্পর আলোচনা-পরামর্শ করে দামেশকের মসজিদে উমরে তৈমুরের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। ওই মজলিসে সর্বপ্রথম বাহাউদ্দীন হালবি তৈমুরকে বললেন, কুরআনের আয়াত নাজিলের ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমরা শুধু এতটুকু জানি যে, মক্কি আয়াত কোনটি আর মাদানি আয়াত কোনটি। সুতরাং আমরা কুরআনের আয়াতের ধারাবাহিকতায় কোনো পরিবর্তন করতে পারব না। সমকালীন বিখ্যাত আলেম ইবনে খালদুনও ওই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। ইবনে খালদুন তৈমুরকে বললেন, ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অপর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি কুরআনের আয়াতের ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করতে পারবে না। অপর উলামায়ে কেরামও ইবনে খালদুনের বক্তব্যকে জোরালো সমর্থন করলেন। এরপর তৈমুর বললেন, আমি আমার সন্তানদের অসিয়ত করছি, তারা যেন আমার পর কখনো কুরআনের আয়াতে পরিবর্তন আনার ইচ্ছা না করে। সমকালীন ওই শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম যদি তৈমুরের সামনে হক কথা না বলতেন, তাহলে হয়তো তৈমুরের মারাত্মক উন্মাদনা কোনো নতুন ফিতনার জন্ম দিত। কিছু আলেমের সাহস তৈমুরের ইচ্ছার সামনে পাহাড়ের মতো কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াল।
মুসলমানদের ইতিহাস তৈমুরের মতো শাসকে ভরপুর, যারা নিজেদের তরবারিকে ইসলামের তরবারি আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের গর্দান উড়িয়েছেন। মুসলমানদের ইতিহাসে এমন আলেমের সংখ্যাও কম নয়, যারা শাসকদের বাসনা ও স্বার্থ রার জন্য ইসলামের শিা বদলে দিয়েছেন। তথাপি ওই ইতিহাসে বাহাউদ্দীন হালবি, ইবনে খালদুন, ইমাম আবু হানিফা রহ: এবং আরো কিছু আলেমের নাম পাওয়া যায়, যারা নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে হক কথা বলে নিজেদের উলামায়ে হক হিসেবে প্রকাশ করেছেন। আজ বাগদাদ থেকে কাবুল ও করাচি থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত মুসলমানদের হাতে মুসলমানদের রক্ত বইয়ে দেয়া হচ্ছে। ইরাকে আবু বকর আল বাগদাদি নিজেকে মুসলমানদের খলিফা ঘোষণা করেছেন। তিনি তৈমুরের মতো মুসলমানদের গাজর-মুলার মতো কেটে পুরা দুনিয়া জয় করতে চাচ্ছেন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, যারা নিজেরা নিজেদের ইসলামের সাচ্চা মুজাহিদ আখ্যা দিয়ে ইসলামের শিাকে বিদ্রƒপ করছে। বুঝে আসে না, মসজিদ আর ইমামবারায় হামলা কোন ধরনের ইসলাম? ইরাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নজরে পড়ে না।
সিরিয়াতেও না, আফগানিস্তানেও না। এমনকি পাকিস্তানেও না। দাবি তো করা হয়, সন্ত্রাসীদের আফগানিস্তানে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্যই সন্ত্রাসী আফগানিস্তানে পালিয়ে গিয়ে থাকবে, কিন্তু আমাদের বলা যাবে কি শিকারপুর, পেশোয়ার ও লাহোরে হামলাকারীরা কোথা থেকে এসেছিল? লাহোরের পুলিশ লাইনে হামলাকারীরা একটি পাকিস্তানি ফোন নম্বর থেকে মিডিয়ার প্রতিনিধিদের ফোন করে হামলার দায় স্বীকার করে। একজন সিনিয়র সাংবাদিককে এসএমএসে জানানো হয়েছে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলী খানকে আমাদের পাকিস্তানের ফোন নম্বর দিয়ে বলুন, আমাদের সাথে কথা বলে স্বীকার করুন, আমরা পাকিস্তানে, নাকি আফগানিস্তানে …। ১৭ ফেব্র“য়ারি দুপুরে লাহোরে পুলিশ লাইনে হামলার সময় আমি ইসলামাবাদে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য শীর্ষ ব্যক্তির সাথে এই প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়ে গেছে। আমাদের বৈঠকে এই প্রতিনিধিদল কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, মৃত্যুদণ্ডের ধারা শুরু হওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসী ঘটনা কমছে না কেন? আলোচনা চলছিল। এমন সময় লাহোরের হামলার খবর এলো। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের মহিলা প্রধান উদ্বেগভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন, গত বারো বছর ধরে পাকিস্তানে বলপ্রয়োগ ও সেনা অভিযান চলছে, যাতে হাজার হাজার লোক মারা গেল। আমাদের প্রতি এক বছর দু’বছর পর পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসীদের পরাজিত হওয়ার সুসংবাদ দেয়। বাস্তবে সন্ত্রাসীদের পরাজয় কবে ঘটবে? প্রতিনিধিদলের অপর এক সদস্য বললেন, ২০০৮ সালের আগে যে কাহিনী আমরা জেনারেল পারভেজ মোশাররফের কাছে শুনেছিলাম, ওই একই কাহিনী আমরা পাঁচ বছর পর্যন্ত আসিফ আলি জারদারির কাছে শুনেছি। আর গত বছর থেকে ওই কাহিনীই নওয়াজ শরিফ শুনিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তি বদলেছে, কাহিনী বদলায়নি। আমি বললাম, সম্ভবত কিছুকাল পরে ওই প্রাচীন কাহিনী আপনারা ইমরান খানের মুখ থেকেও শুনবেন। হাসির রোল পড়ে গেল। অতঃপর সবাই লাঞ্চের টেবিলে গিয়ে বসলেন।
লাঞ্চের টেবিলে বসে আমি ভাবতে লাগলাম, ইসলামের নামে কুফরির ফতোয়া প্রদান, খুনখারাবি ও মারামারির উপাখ্যান অনেক পুরনো। ওই খুনখারাবি ও মারামারি থামানোর জন্য বেশ কয়েকবার উলামায়ে হকও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু গত বারো বছর উলামায়ে কেরাম কী ভূমিকা পালন করেছেন? নিঃসন্দেহে মাওলানা হাসান জান ও মুফতি ড: সারফারাজ নায়িমীসহ বেশ কয়েকজন আলেমকে শুধু এ জন্য শহীদ করা হয় যে, তারা আত্মঘাতী হামলাকে হারাম বলেছিলেন। ওই আলেমদের শাহাদতের পর কিছু আলেমের মুখ নীরব হয়ে গেছে। কেননা রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দেয়ার মতা রাখে না। সম্প্রতি মাওলানা জাহেদুর রাশেদি তার নাওয়ায়ে হকে আমাদের ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর সময় এক নামসর্বস্ব ইসলামের মুজাহিদ যাহহাক কুফা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর বললেন, যে তার আনুগত্য মেনে নেবে না, তাকে মুরতাদ আখ্যায়িত করে হত্যা করা হবে। ইমাম আবু হানিফা রহ: ওই জালেমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, যতণ কোনো মুসলমান তার ধর্মত্যাগ করে অপর ধর্ম গ্রহণ না করবে, তুমি তাকে মুরতাদ আখ্যায়িত করতে পারবে না। তাকে হত্যারও নির্দেশ দিতে পারবে না। যাহহাক বিষয়টা বুঝতে পারলেন। অতঃপর তিনি কুফাবাসীকে মা করে দিলেন। যদি ইমাম আবু হানিফা রহ: নিশ্চুপ থাকতেন, তাহলে ইসলামের নামে মুসলমানদের গণহত্যা করা হতো। আজকের উলামায়ে হককেও ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতো শুধু পথহারা যুদ্ধবাজ নয়, বরং শাসকদের ভুল পলিসির বিরুদ্ধেও যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে সত্যের আওয়াজকে উঁচু করতে হবে। যে কাজ আলেমরা করতে পারেন, তা সরকার করতে পারে না। কুফরির ফতোয়া প্রদান, হত্যা ও আত্মঘাতী হামলার মতো বিষয়গুলো নিয়ে সব শীর্ষ আলেমের একসাথে বসা উচিত। যদি সম্ভব হয়, তাহলে আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও ইরানের আলেমদেরও এই পরামর্শে শামিল করা যেতে পারে। অতঃপর এ বিষয়ে এক যৌথ সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হোক। এ যৌথ সিদ্ধান্ত আজকের নয়া ফিতনাগুলো নিঃশেষ করতে পারবে। বাহাউদ্দীন হালবি ও ইবনে খালদুন তৈমুরের সামনে যে ভূমিকা পালন করেছেন এবং যাহহাকের সামনে ইমাম আবু হানিফা রহ. যে ভূমিকা পালন করেছেন, আজকের উলামায়ে কেরাম সেই ভূমিকা কেন পালন করতে পারছেন না? আজকের উলামায়ে কেরাম যদি তাদের পূর্বসূরিদের পথে পা বাড়ান, তাহলে শুধু পাকিস্তান নয়, বরং ইসলামেরও অনেক বড় খেদমত হবে। আর পুরনো কাহিনী থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।
মূল: হামিদ মীর, পকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব