বিক্রি হয়েছে ২২ কোটি টাকার বই
পর্দা নামলো অমর একুশে গ্রন্থমেলার
পর্দা নামলো মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার। শেষ হলো পাঠক-লেখকদের আড্ডা। ভাঙলো বইপ্রেমীদের মিলনমেলা। আবারো শুরু হলো এগারো মাসের অপেক্ষা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রাচীন বট আর বর্ধমান হাউসের চারপাশ আজ থেকে শুরু হবে শুধু অন্ধকার। খাঁ খাঁ করবে জনমানুষের শূন্যতায়। কারণ শেষ হয়ে গেল বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সবচেয়ে বৃহত্তর আয়োজন অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
উল্লেখ্য, গত বছরের মতো এবারের বইমেলাও অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমি সম্মুখস্থ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। উভয় চত্বরে মোট ৩৫১টি প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ৫৬৫টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বছরই প্রথমবার বাংলা একাডেমিসহ মোট ১১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিটির জন্য ৪০০ বর্গফুটের প্যাভিলিয়ন প্রদান করা হয়। উন্মুক্ত জায়গাসহ ৭২টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউজের দক্ষিণ পাশে লিটলম্যাগ কর্নারে জায়গা করে দেয়া হয়। মেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই শতকরা ৩০ ভাগ কমিশনে এবং ২০০০ সালের আগে প্রকাশিত একাডেমির বই শতকরা ৭০ কমিশনে বিক্রি করা হয়। মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ ভাগ কমিশনে বিক্রি করে।
বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমিসহ সব প্রকাশনী মিলে বিক্রি হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকার বই। গত বছরের তুলনায় যা সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বেশি। বাংলা একাডেমিরই বিক্রি দেড় কোটি টাকা বলে গতকাল শনিবার মেলার শেষদিন সন্ধ্যায় সমাপনী অনুষ্ঠানে মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জানিয়েছেন। গত বছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বই। গত বছরের চাইতে এবার সাড়ে ৫ কোটি টাকার বই বেশি বিক্রি হয়েছে। এবারের মেলায় মোট ৩ হাজার ৭শ’ বই প্রকাশিত হয়েছে। সমাপনী দিনে মেলায় নতুন বই আসে ১২৫টি এবং ১৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
এদিকে, আজ রোববার থেকে আবারো আগের চেহারায় ফিরবে বাংলা একাডেমি। আর কানে ভেসে আসবে না নতুন বই আর মোড়ক উন্মোচনের খবর। থাকবে না লেখক আর পাঠকের আড্ডা। আর কেউ স্টলে স্টলে খুঁজবে না নতুন বই। টানা এক মাসের মেলা শেষ করে গতকাল শনিবার ঘরে ফিরে গেলেন লেখক-প্রকাশকরা। তবে শেষ মুহূর্তের ভালোলাগা আর আনন্দের নির্যাস নিতে ভোলেননি কেউই। আর দর্শনার্থীরা অনান্য দিনের মতোই শেষ দিনেও আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়েছেন।
প্রকাশকদের দাবি ছিল মেলার সময় সাতদিন বাড়ানো। কিন্তু নানা কারণে মেলা কর্তৃপক্ষ সে দাবি নাকচ করে দিয়ে মেলার দ্বার খোলার সময় এগিয়ে এনেছিল। সে অনুযায়ী, গতকাল শেষদিনও সকাল ১১টার বদলে ১০টায় মেলার প্রবেশ পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর দর্শনার্থীর সরব উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল গতকালের একাডেমি প্রাঙ্গণ। অনেকেই আবার শেষদিনের স্মৃতিটুকু ক্যামেরাবন্দী করে রেখেছেন। শেষদিন উপলক্ষে বিভিন্ন স্টলে ছিল বিশেষ ছাড়। অনেক পাঠকই এসেছেন শেষ দিনের এই বিশেষ ছাড় গ্রহণ করতে।
গতকালের আলোচনা: বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় নাট্যকার শম্ভু মিত্র শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন হাসান ইমাম, এস.এম. মহসীন এবং শাহাদাৎ হোসেন নিপু। সভাপতিত্ব করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। বক্তারা বলেন, বাংলা নাটকে আধুনিকতার পথ নির্মাণ ও সৃজনে বহুমাত্রিকতা এবং ঐতিহ্যভাবনার কথা যখন ওঠে, তখন খুব শ্রদ্ধাভরে আমরা শম্ভু মিত্রকে (১৯১৫-৯৭) স্মরণ করি। কতভাবেই না তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চকে করে তুলেছিলেন ঐতিহ্যিক প্রবাহের সঙ্গে ঐশ্বর্যবান ও আধুনিক। মঞ্চে প্রাণশক্তি সঞ্চারে নবধারার প্রবর্তক তিনি। বহুরূপী ও তার নির্দেশিত নাটক বোধে নবীন ও দীপ্তিতে উজ্জ্বল; বাংলা মঞ্চধারায় নতুন প্রতিশ্রুতির প্রবর্তক। শুধু রবীন্দ্র-নাটকের প্রয়োগরীতি ও মঞ্চকুশলতার জন্যই নয়, নাটককে উৎকর্ষের উচ্চতায় পৌঁছানোর সাধনায় তার তুল্য ব্যক্তি নেই। সামগ্রিকভাবে তার বোধ, বুদ্ধি, সাধনা ও সিদ্ধি উপলব্ধির জন্য পূর্বকালীন মঞ্চধারার রীতি ও শম্ভু মিত্র-প্রবর্তিত নাট্যধারা সম্পর্কে ধারণা থাকা আমাদের বাঞ্ছনীয়। জন্মশতবর্ষে তার জীবন ও সৃষ্টির দিকে নতুন অবলোকন প্রয়োজন।
সমাপনী অনুষ্ঠান: মেলার মূলমঞ্চে সন্ধ্যা ছয়টায় ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫’র সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫’র সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন গ্রন্থমেলা আয়োজন সহযোগী টেলিটক বাংলাদেশের উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহ জুলফিকার হায়দার এবং লন্ডনে বাংলা একাডেমি বইমেলা আয়োজনের সংগঠক গোলাম মোস্তফা। অনুষ্ঠানে প্রধান ও বিশেষ অতিথি ছিলেন যথাক্রমে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমরা আজ পৃথিবীর দীর্ঘতম গ্রন্থমেলার সমাপন ঘটাতে যাচ্ছি। এত দীর্ঘ গ্রন্থোৎসবের আয়োজন আমাদের জন্য বিপুল গৌরবের ব্যাপার। এই গ্রন্থমেলা কেবল বিকিকিনির মেলা নয় বরং চেতনার অভূতপূর্ব মিলনোৎসবও বটে। মেলাকে আমরা বাংলা একাডেমি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের গন্ডি পেরিয়ে একটি ধারাবাহিক কার্যসূচিতে পরিণত করতে চাই। ভবিষ্যতে জেলাভিত্তিক বইমেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তৃণমূলের মানুষের কাছে সহজে বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পরিচালিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার-২০১৪ প্রদান করা হয় কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকবাল হাসান এবং লেখক ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ ইকবাল। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের হাতে পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০ হাজার টাকার চেক, পুষ্পস্তবক, সনদ এবং ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক গুণমানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশের জন্য মাওলা ব্রাদার্সকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’, মুর্তজা বশীরের আমার জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশের জন্যে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে, রবীন্দ্রসমগ্র খ–২৩ প্রকাশের জন্যে পাঠক সমাবেশকে ‘শহিদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’, ২০১৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক গুণমানসম্মত শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য সময় প্রকাশনকে ‘রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ হিসেবে ২৫ হাজার টাকার চেক, সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় প্যাভিলিয়ন ক্যাটাগরিতে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডকে ২০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট, সনদ ও স্টল ক্যাটাগরিতে প্রথমা প্রকাশন এবং জ্যার্নিম্যান বুকস্কে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ হিসেবে প্রতিটিকে ১৫ হাজার টাকা করে চেক, সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, শাম্মী আখতার, তপন মাহমুদ, ফেরদৌস আরা, অদিতি মহসিন, সুজিত মোস্তফা, তালাত সুলতানা, ফারহানা ফেরদৌসী তানিয়া, মো. সারোয়ার হোসেন এবং পারভীন আক্তার।