বিবিসি সংলাপে অভিমত
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতায় ভিন্নমত প্রশ্রয় পাচ্ছে না
বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নেয়া আলোচকেরা বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কারণে ভিন্ন মত প্রশ্রয় পাচ্ছে না। আর অসহিষ্ণুতার কারণেই দেশে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটে।
তারা বলেন, দেশের চলমান সঙ্কট নিরসনে শুধু দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে সংলাপ হলে চলবে না। আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই এ ব্যাপারে আমাদের সাধারণ মানুষদেরও বিভিন্ন স্তরের সংলাপে বসতে হবে। এ ছাড়া দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়েও সংলাপে আলোচনা হয়।
রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপের ১০৬তম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্যানেল আলোচক ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম, ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন।
‘নিরাপত্তা-বেষ্টিত একটি এলাকায় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকান্ড কি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে? দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে আমেনা মোহসিন বলেন, বাংলাদেশে যে ধরণের অসহিষ্ণু রাজনীতি চলছে তাতে আমরা কারো ভিন্নমতকে প্রশ্রয় দিতে পারছি না। জাতীয় বা রাজনৈতিক মানচিত্র দ্বারা আমাদের সামাজিক মানচিত্র আক্রান্ত হচ্ছে। আর এরই প্রতিফলন এ হত্যাকান্ডের ঘটনা।
বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর বলেন, এর আগে এমন যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর একটারও বিচার হলে এমন ঘটনা ঘটতো না।
এ সময় অপর এক দর্শক প্রশ্ন করেন-ধর্মীয় বিধান নিয়ে কটাক্ষ করা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা ছাড়া কি মুক্তচিন্তা করা যায় না?
জবাবে ড. মশিউর রহমান বলেন, অভিজিৎ অনেক হুমকির মুখেও যেভাবে সাহস নিয়ে এসেছেন তাতে আমরা তাকে বীর বলতে পারি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও কিন্তু এমন সাহসিকতাকে সঙ্গী করেই হয়েছিলো। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা অধর্ম করে তাদেরকে নিয়েই কটাক্ষ করেন অভিজিতের মতো লোকেরা।
তিনি বলেন, ধর্মের নাম করে অন্য কোনো ব্যক্তির মতামতের বিরোধিতা করেছেন তারা। এখানে মূল্যবোধের অসহিষ্ণুতা কাজ করছে। দুটো জিনিসকে আলাদা করে দেখা দরকার। আস্তিক বা নাস্তিক সবারই এ পৃথিবীতে থাকার অধিকার আছে। এটা যারা মানতে পারবে না। তারা দোষী এবং অবশ্যই তাদের শাস্তি পেতে হবে। এসময় বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর বলেন, ধর্মের সাথে খুনকে সম্পৃক্ত করা উচিত না।
আব্দুর রশীদ বলেন, যদি কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠি মানুষের মতাদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে তবে তারা উগ্রমতাদর্শী। ব্লগার মানেই নাস্তিক না। অভিজিৎ বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখতেন। মুক্তচিন্তা করতেন। মুক্ত চিন্তা মানেই ধর্মবিরোধী চিন্তা না।
আমেনা মোহসিন বলেন, আমাদের অসহিষ্ণুতার কারণে তৃতীয় একটি শক্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অবশ্যই কারো ধর্মীয় অনুভূতিকে আমরা আঘাত করতে পারিনা। আমাদের দেশে আস্তিকরা বাস করবেন আবার নাস্তিকরাও বাস করবেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এটাই অবাক লাগছে।
‘মিটমাট হবে না, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর এমন বক্তব্যে এক দর্শক প্রশ্ন তোলেন।
পরে মশিউর রহমান বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে তা হলো বিদ্রোহী দলের দাবি। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো এ রাষ্ট্রটাকে ভেঙে অন্য কোনো ধরণের রাষ্ট্র তৈরি করা। এ রাষ্ট্রের যে ভিত্তি তা অতিক্রম করে তারা এ দাবি করছে। আমার বাড়িতে এসে যদি কেউ বলে, এটা না দিলে আমি বাড়িতে আগুন দেবো, তবে আমি কখনোই এ দাবি মেনে বাড়ি বাঁচাতে যাবো না। যারা অপরাধ করছে তাদেরকে দমন করতে হবে। তবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শাহজাহান ওমর বলেন, এখন যে আন্দোলন বা অসষ্ণিুতা চলছে তা আদর্শগত সংঘাত নয়। জনগণের স্বার্থে আমরা আন্দোলন করবো, তা যদি আসলেই জনগণের স্বার্থে হয় তবে জনগণ আমাদের সাথে থাকবে। তা না হলে জনগণই আমাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে।
তিনি আরো বলেন, জামায়াত যদি এতো খারাপ হয়ে থাকে, তাকে নিষিদ্ধ করেন না কেনো? এসময় দর্শক-শ্রোতার হাততালি দেন।
আমেনা মোহসিন বলেন, বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব তা ক্ষমতার সাথে মিলিয়ে ফেলছি কিনা তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। আর তাদের সাথে বিএনপির সাথে দ্বন্দ্ব কোথায় তা বলতে হবে। জামায়াতের সাথে আঁতাতের ব্যাপারে বিএনপিকেও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। আমার মনে হয়, এখন যে অবস্থা তা শুধু দু’দলের মধ্যে সংলাপ নয়, আমাদের সাধারণ মানুষদেরও বিভিন্ন স্তরের সংলাপে বসতে হবে, যে আমরা কেমন ধরনের রাষ্ট্র চাই।
লঞ্চ দুর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এ ধরণের দুর্ঘটনা বন্ধ করতে সরকারের কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত?
এমন প্রশ্নের জবাবে মশিউর রহমান বলেন, নদীর নাব্যতা বা জাহাজের সার্টিফিকেট দেয়ায় কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটা চিহ্নিত করতে হবে। হাহাকারের চেয়ে অ্যাকশনটা বেশি করতে হবে।
শাহজাহান ওমর বলেন, চালকের লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে আরো জোড় দিতে হবে। সেইসাথে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দিকেও খেয়াল রাখা উচিত।
আমেনা মোহসিন বলেন, একটা বিচারহীনতার ব্যাপার আছে। যারা এগুলোর জন্য দায়ী তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
আব্দুর রশীদ বলেন, নদী সমস্যা ও এদের মেইনটেনেন্স সংক্রান্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আর দুর্ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।