‘মা’ হওয়ার অনুভূতি
শামিমা শিরীন শিউলি: ২০ অক্টোবর গিয়েছিলাম ডা. আমেনা খান-এর চেম্বারে মা, আমি তার রনী। ডাক্তার পেলাম না। এদিকে পাঁচ বছর বয়সী মীম যে আমার বড় বোনের মেয়ে সে বাসায় ছিল খুব আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে, আন্নি হাসপাতাল থেকে বাবু কিনে নিয়ে আসবে।
আমরা বাসায় আসলাম। মিম জিজ্ঞেস করল, আন্নি, বাবু কিনে আন নাই। আমি বললাম, ডাক্তার ছিল না তাই আনতে পারিনি।
আমাদের প্রতিবেশীরা মীমকে জিজ্ঞেস করল, তোমার আন্নি বাবু এনেছে? সে বলল, দোকান বন্ধ ছিল তাই বাবু কিনতে পারেনি। ওর কথা নিয়ে নিয়ে সবাই হাসতে লাগল।
বাসায় এসে জানতে পারলাম ডাক্তার কাল আসবে তাই আমাদের যেতে বলল। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে মনটা খারাপ হয়ে গেল যদি মরে যাই এই ভেবে। নিজের বরের কাছ থেকে শান্তনা আর আত্মবিশ্বাস পেয়ে সতেজ হলাম।
এরপর গোসল করে প্রস্তুত হই। দুপুর থেকে খাওয়া বন্ধ। দুপুরে খুব মজার খাবার রান্না হয়েছিল, কিন্তু খেতে পারিনি। যোহরের নামায পড়ে মা, শাশুড়ি, বড় আপা, মিম, রনী সবাই হাসপাতালে যাই। আমি আমার সাংগঠনিক বোনদের গকাছে দোয়া চেয়ে এসএমএস পাঠাই। মহানগর সভানেত্রী সাফা আপু সাথে সাথে রেসপন্স করে বলে ‘ফি আমানিল্লাহ।’
তারপর ডাক্তার, নার্সদের তত্ত্বাবধানে চলে যাই। স্যালাইন শুরু হলে খুব ভয় হচ্ছিল। কি হবে, বাঁচবো, নাকি মরেই যাবো। ছোট সময় আমার টনসিল অপারেশন হয়েছিল। তখন মরণ কি জিনিস জানতাম না। নাচতে নাচতে অপারেশন এর বেডে শুয়ে পড়েছিলাম। এখন বড় হয়েছি, মৃত্যু কি জিনিস বুঝি। ভাল কাজ করলে আল্লাহর কাছে পুরস্কার বেহেস্ত আর মন্দ কাজ করলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। তাই এখন ভয় হয়।
চারটা বাজে আমি অপারেশন বেডে শুয়ে পড়লাম। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম। আমাকে অবশ করে দেওয়া হলো। আমি আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম। মনে হলো আমি এক ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা। ৫-৬ মিনিট পরেই আমি এক শিশুর চিৎকার শুনতে পাই। ঘুমের রাজ্যে চলে গেলেও কর্ণদ্বয় কিছুটা অনুভব করছিল। এর পর আর কিছু মনে নেই। কয়েক ঘণ্টা পর আমার জ্ঞান ফিরলে আম্মু মানে আমার শাশুড়ির কথা শুনতে পাই। আমার হাত পায়ের শক্তি ফিরে আসছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখ মেলে দেখি আমার হাত ধরে বসে আছে আমার প্রাণপ্রিয় রনী। আগেই বলেছিলাম, ওটিতে আমার একা থাকতে ভয় লাগে। আমাকে একা ফেলে রেখো না। আমার পাশে থেকো। তাই সে হাজির। ডাক্তার, নার্স সবাই তাকে বারণ করেছিল, সবার কথা উপেক্ষা করে সে আমার পাশে হাজির। সত্যি তাকে দেখে আমি এতই অবাক হলাম যে, আমার কোন কষ্ট নেই।
আমার বমি আসছিল। রনি বারবার পরিষ্কার করে দিল। আমি রনিকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা কোথায়? বলল, সে দোতলায় বাবুকে নিয়ে আছে। আমি আমার সন্তানের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বলল, তোমার ছেলে হয়েছে, সে সুস্থ আছে মা মনির কোলে। দুই ঘণ্টা পর আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে লিফট করে দুই তলায় নিয়ে আসলো। লিফট খোলার সাথে সাথেই দেখি আব্বা, নাঈম, আপা, মিম, আম্মু আর রনি দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে দেখে ভীষণ ভাল লেগেছিল আমার। প্রাণের মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়।
এরপর আমাকে বেড়ে শোয়ানো হলো। রনি সব সময় আমার পাশেই ছিল। কি যে প্রশান্তি লেগেছিল, বলে বোঝানো যাবে না। ২১-১০-১৩ আমার নারী জনম সার্থক হয়েছে। আমাকে ধন্য করেছে এই ছোট্ট শিশু। রনি আমার সামনে আমার সন্তানকে এনে দিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই শিশুটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার আত্মার সাথে জড়িত। আমার রক্ত মাংসে সে গড়া এ যেন আমারই জীবন। আমার খুব ভাল লেগেছিল যে, আমি মা হয়েছি। এতদিন শুধু আমিই মা ডেকেছি। এখন আমাকে মা ডাকবে। মনে হলো আমার মর্যাদা আকাশচুম্বি বেড়ে গেল। আমি ‘মা’, ‘মা।’
আমার সন্তানের নাম আমিই আগে ঠিক করে রেখেছিলাম, ‘রাইয়ান রহমান নূর’ রনি সবাইকে ফোন করছিল আর নাম বলছিল সাথে সাথে।
আমার রনির কাছে আমি শুধু হারতেই থাকি। তার ভালবাসা, তার উদারতা, তার আচরণ, তার বিশালতা, তার স্নেহপরায়ণতা সব কিছু দিয়ে সে জিতে যায়।
সে এক অবাক কান্ড করে বসল, ২৩-১০-১৩ সকালে ঘুম থেকে উঠি। ডাক্তার আজ চা-বিস্কুট খেতে বলেছে। রনি ফজরের নামাযের জন্য বের হল। অনেক বেলা হয়ে গেছে আসে না। সবাই টেনশন করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ১০০ গোলাপ নিয়ে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। বললাম, এতো ফুল কোথা থেকে এনেছো। বলল, শাহবাগ থেকে। শুনে সবাই অবাক হলাম। আমার রুমে যখনই নার্সরা আসে, ফুল দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। তাদের সবাইকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাই। আমাকে যে সবাই ভালোবাসে, সে জন্য আমার আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়া জানাই।
আমি মা হয়েছি। আমার পায়ের নীচে কারো বেহেস্ত হয়েছে। আমার আল্লাহর সাহায্য নিয়ে তাকে নামাযী বানাবো, তাকওয়া সম্পন্ন বানানো। সর্বোপরি আল্লাহর সাথে পূর্ণ পরিচয় করাবো। হে আল্লাহ, আমার নূরকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করে নাও।
লেখক : ইসলামী সমাজকর্মী, নারায়ণগঞ্জ